বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আগামী পরীক্ষা পদ্ধতিতে নানা ধরনের পরিবর্তন আসছে। ইতিমধ্যেই কিছু পরিবর্তন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে আর কিছু পরিবর্তন প্রস্তাব আকারে রয়েছে। তবে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন (এমসিকিউ) পদ্ধতিতে ২০০ নম্বরের দুই ঘণ্টার পরীক্ষার বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত। ৩৫তম বিসিএস থেকেই এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা হবে। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি তাদের প্রস্তাবে
এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। লিখিত পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানোর প্রস্তাবও করেছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। জানা গেছে, পাঠ্যক্রমেও আসছে পরিবর্তন। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় যোগ হচ্ছে নতুন কিছু বিষয়। এসব নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক আর গবেষণা; কিন্তু পরীক্ষার কোনো খবর নেই। এদিকে একটি পরীক্ষার আগে এত সব পরিবর্তনের ব্যাপারে বেশ ঝামেলায় পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পিএসসি। প্রস্তাব-পরিকল্পনার চাপে তালগোল পাকানোর দশা হয়েছে তাদের। আবার পরীক্ষা পদ্ধতি চূড়ান্ত না হওয়ায় দেওয়া যাচ্ছে না ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি। সাধারণত ১১ থেকে ১২ মাস পরপরই দেওয়া হয় বিসিএস পরীক্ষার নতুন বিজ্ঞপ্তি। কিন্তু ৩৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর ১৮ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো দেওয়া হয়নি ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি। আর নতুন বিজ্ঞপ্তি না দেওয়ায় চাকরির বয়স হারানোর দুশ্চিন্তায় পড়েছেন হাজারো শিক্ষার্থী। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরীক্ষা পদ্ধতির কিছু সংস্কার চূড়ান্ত করে আমাদের কাজ শেষ করছি। আগামী মন্ত্রিসভা বৈঠকে এটি ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।’ জানা যায়, আগামীকাল সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠক হওয়ার কথা। পিএসসির পরীক্ষা সংস্কারবিষয়ক বিসিএস বিধিমালাটি যদি এই মিটিংয়ে পাস হয় তাহলে তা সংসদে পাঠানো হবে। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে সংসদ অধিবেশন বসবে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। যদি সংসদে এটি পাস হয়, এরপর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন শেষে পিএসসিতে যাবে। এরপরই পিএসসি ৩৫তম বিসিএসের নতুন বিজ্ঞপ্তি দিতে পারবে। গত দুবার বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া মো. শাহাদাত হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার সব পরীক্ষায়ই প্রথম শ্রেণি আছে। বিসিএস পরীক্ষার জন্য চার বছর ধরে নিয়মিত পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি। আমার বিশ্বাস, এবার আমি পার হবই। কিন্তু এখন আমার স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বয়স। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর আমার ৩০ বছর পূর্ণ হয়ে যাবে। এর মধ্যে বিজ্ঞপ্তি না দিলে আমার সব স্বপ্ন মাটি।’ জানা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পাস করে বেরোতে বেরোতেই ২৬-২৭ বছর বয়স হয়ে যায়। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ বছরের অনার্স-মাস্টার্স কোর্স করতে আট-নয় বছর সময় লেগে যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাস করে বেরোতে ২৮-২৯ বছর বয়স হয়ে যায়। ফলে দু-তিনবারের বেশি কেউ বিসিএস দেওয়ার সুযোগ পান না। দেড় বছরেও নতুন বিজ্ঞপ্তি না হওয়ায় ইতিমধ্যেই হাজারো প্রার্থী তাঁদের চাকরির বয়স হারিয়েছেন। দ্রুত বিজ্ঞপ্তি না হলে আরো কত প্রার্থী যে বয়স হারাবেন তার ইয়ত্তা নেই। পিএসসির সদস্য মাঈন উদ্দিন খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুব তাড়াতাড়িই ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। পরীক্ষা পদ্ধতিতে কিছু সংস্কার হচ্ছে। প্রিলিমিনারিতে ১০০ নম্বরের বদলে ২০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষাই বড় পরিবর্তন। বিস্তারিত পরীক্ষা পদ্ধতি নতুন বিজ্ঞপ্তির সঙ্গেই জানিয়ে দেওয়া হবে। আমরা আশা করছি, আগামী মাসের প্রথম দিকেই ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দিতে পারব। আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির কোনো সুপারিশ এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি।’ জানা যায়, ইতিমধ্যেই পিএসসির প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ২০০ নম্বরে নিতে বিধিমালা সংশোধন করে তা চূড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সংশোধিত বিধিমালায় এক ঘণ্টার স্থলে দুই ঘণ্টা প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হবে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আবেদনপত্রের মূল্য ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। তবে প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিত তথা অনগ্রসর নাগরিকদের জন্য আবেদনপত্রের মূল্য ১০০ টাকা করা হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় পাস নম্বর গড়ে ৫০ শতাংশ থাকলেও মৌখিক পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় ৩০ নম্বরের কম পেলে প্রার্থী কোনো নম্বর পাননি বলে গণ্য হবে, আগে যা ছিল ২৫। আগের মতো একটি ভুল উত্তরের জন্য দশমিক ৫০ নম্বর কাটা হবে। বয়স, যোগ্যতাসহ আর কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়নি। পিএসসি সূত্রে জানা যায়, তারা প্রিলিমিনারিতে ৩০০ নম্বরের পরীক্ষার প্রস্তাব করেছিল। আর বিষয়ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষার প্রথম পত্রে ২০০ নম্বরের পরীক্ষার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যার সময় হবে তিন ঘণ্টা। আর দ্বিতীয় পত্র ১০০ নম্বরের, যার সময় থাকবে তিন ঘণ্টা। বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রতে আলাদা আলাদাভাবে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা তিন ঘণ্টায় নেওয়া হয়। এই প্রস্তাবের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। তা ছাড়া পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদনে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন না করেই তা সরলীকরণের সুপারিশ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা, নারী, প্রতিবন্ধী, উপজাতিসহ প্রাধিকার কোটা জেলাভিত্তিক না করে মেধার ভিত্তিতে সারা দেশের জন্য করার সুপারিশ করা হয়েছিল। সে বিষয়েও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পিএসসি যেখানে প্রিলিমিনারির এমসিকিউ পরীক্ষার নম্বর বাড়াচ্ছে, সেখানে সেই এমসিকিউ তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সম্প্রতি কমিটির বৈঠকে মেধার যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় এই পদ্ধতির বিকল্প কিছু খুঁজে দেখতে সংশ্লিষ্টদের কাছে সুপারিশ রাখা হয়েছে। এ নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিতর্কের। পিএসসি বলছে, প্রিলিমিনারিতে এমসিকিউয়ের পরিবর্তে রচনামূলক প্রশ্নপত্র চালু হলে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। প্রিলিমিনারিতে পাস করার পর যোগ্য প্রার্থী খুঁজতে রচনামূলক পদ্ধতিতে বড়সড় পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে এমসিকিউ পদ্ধতির অপটিক্যাল মার্ক রিডার (ওএমআর) শিটের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে মেশিনের মাধ্যমে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগে। কিন্তু একটি লিখিত উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে একজন পরীক্ষকের অন্তত ২০ মিনিট করে সময় লাগবে। দক্ষ পরীক্ষক নিয়োগেও সমস্যায় পড়তে হবে। এখন প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রায় দুই মাসের মধ্যে প্রকাশ করা সম্ভব হলেও রচনামূলক পদ্ধতিতে তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এ ছাড়া পিএসসি বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য বিস্তারিত পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এতে বর্তমানের বিষয়গুলোর সঙ্গে নতুন করে আরো কয়েকটি বিষয় যোগ হচ্ছে। ৩৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির আগেই প্রকাশ করা হবে নতুন পাঠ্যসূচি। পিএসসি কর্তৃপক্ষ আশা করছে, নতুন পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করতে সুবিধা হবে। নতুন বিষয়গুলো হচ্ছে- ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন। আগে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার প্রশ্নে থাকত বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান, বাংলাদেশ বিষয়াবলি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, গাণিতিক যুক্তি ও মনোবিজ্ঞান। ইংরেজি বিষয়ে প্রশ্নের সংখ্যা বেশ বাড়বে। গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে গভীরতর প্রশ্ন হবে। ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক বিষয়েও পরীক্ষার্থীদের দক্ষ হতে হবে। নম্বর ও সময় বাড়ায় সব বিষয়েই প্রশ্নের সংখ্যা বাড়বে বলে জানা যায়। সাধারণ ছাত্র পরিষদের সভাপতি আল আমিন রাজু বলেন, ‘সেশনজট একজন শিক্ষার্থীর জীবন থেকে চার-পাঁচ বছর কেড়ে নেয়। তাই আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাকরিতে প্রবেশের শেষ বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্য আন্দোলন করছি। যদি দেড় বছর ধরে নতুন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া না হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা যাবে কোথায়? পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের বিপক্ষে আমরা নই। তবে সংস্কারের আগে অবশ্যই সময়ের দিকটি খেয়াল রাখা উচিত ছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যত দ্রুত সম্ভব ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
No comments:
Post a Comment