অভিজাত এলাকা উত্তরা মডেল টাউন। কী নেই সেখানে। শপিং মল, বিশ্ববিদ্যালয়, নামিদামি স্কুল-কলেজ, ক্লিনিক ও হাসপাতাল- সবই আছে। এর পরও নানা সমস্যার মধ্যে জীবন যাপন করতে হচ্ছে উত্তরাবাসীকে। রাস্তার বেহাল দশা বড় একটি সমস্যা; দীর্ঘদিন ধরেই এ সমস্যা বিরাজ করছে। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে সবাইকে। একটু বৃষ্টি হলেই পানিতে সয়লাব হয়ে যায় মূল রাস্তা। বিভিন্ন সেক্টরের ভেতরের রাস্তাগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ।
বাসার সামনে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সব কটি সেক্টরের রাস্তা ভাঙা। ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের উৎপাতও রয়েছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই এলাকায়। প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে। আর কল্যাণ সমিতির নেতাদের কোনো দায়িত্ব নেই বললেই চলে। এলাকাবাসী অভিযোগ করেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের নজরদারি নেই। উন্নয়নের নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই দুটি সংস্থা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আবার বাড়িওয়ালারা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন। ডিসিসির কোনো নিয়মের মধ্যেই কেউ থাকছে না। ১৯৬৫ সালে নিরিবিলি পরিবেশে আদর্শ জীবনযাপনের জন্য উত্তরা মডেল টাউন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। প্রতিশ্রুতি ছিল, ১ নম্বর থেকে ১৪ নম্বর সেক্টরে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ সব রকম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে। সরকারি এ উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকার অভিজাত শ্রেণির মানুষ প্লটের জন্য আবেদন করে। কিন্তু দীর্ঘ ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই পরিকল্পনার ২০ শতাংশও পূরণ হয়নি। এখানে নেই কোনো সরকারি হাসপাতাল, বিদ্যাপীঠ, পাঠাগার, কাঁচাবাজার, বিপণিকেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টার কিংবা নারী-শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যা কিছু হয়েছে, তা এলোমেলো, আগোছালো। যানজট, অবৈধ দখল, জলাবদ্ধতা, ভাঙাচোরা রাস্তা, ড্রেনেজ সংকট, পানি ও গ্যাস সমস্যা, চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের দৌরাত্ম্য, পরিবেশদূষণ, আবাসিক ভবনের পাইকারি বাণিজ্যিকীকরণ, মাদক ব্যবসা, ভিনদেশি অপরাধীসহ নানা সমস্যা উত্তরাবাসীর নাভিশ্বাস তুলছে। আবার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে অসামাজিক কর্মকাণ্ডও চলে। সেক্টরের ভেতরে অবৈধভাবে ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। থানা পুলিশ মাসোয়ারার বিনিময়ে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১ নম্বর সেক্টর থেকে ১৪ নম্বর সেক্টরের প্রায় প্রতিটি রাস্তা ভাঙাচোরা, নানা সমস্যায় জর্জরিত। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির পর সমস্যা সমাধানের জন্য কর্তৃপক্ষ সরব হয়ে ওঠে। আবার কিছুদিন যেতে না যেতে তা আবার নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। এলাকাবাসী প্রতিকার পেতে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে ধরনা দিয়েও লাভ হয় না। দায়সারাভাবে সংস্কারকাজ করার কারণে প্রতিবছর বর্ষায় রাস্তা ভেঙে যায়। সংস্কারকাজে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। যেকোনো এলাকা থেকে প্রধান সড়কে আসার জন্য যে সামান্য গলিপথ, সেখানেই প্রতিদিন দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। মাসকট প্লাজার সামনে থেকে শুরু ‘জনপথ’ রোডটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো থাকার পর সম্প্রতি আধাপাকা করা হয়েছে। কিছুদিন যেতে না যেতে রাস্তার কিছু স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। ১০ ও ১২ নম্বর সেক্টরের ১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর সড়কের অবস্থা করুণ। ভাঙাচোরা সড়কের পাশেই আবার ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। ১১ নম্বর সেক্টর আরো বেশি অবহেলিত। প্রতিটি রাস্তা ভাঙা। বিশেষ করে ২, ৩/এ, ১৫, ১৮, ১৯ নম্বর রোডের অবস্থা শোচনীয়। জনপথ রোডে বাসাবাড়ির সামনেই বিশাল ময়লার স্তূপ। ৭ নম্বর সেক্টরের প্রতিটি রাস্তা ভাঙা। অথচ এই সেক্টরে বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৯ নম্বর সেক্টরের বেশির ভাগ রাস্তা ভাঙা। ১, ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরের প্রায় সব কয়টি রাস্তা ভাঙা; আবার অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়। তবে ৪ নম্বর সেক্টরের বেশির ভাগ রাস্তা মেরামত করা হয়েছে। আবার ৫ ও ৬ নম্বর সেক্টরের রাস্তাগুলো শোচনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। প্রতিটি সেক্টরের রাস্তাগুলো বছরের পর বছর ধরে মেরামত না করায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসী বলছে, দীর্ঘদিন ধরে ডিসিসি নির্বাচন না হওয়ায় নগরবাসীর এ দুরবস্থা। উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা আবদুর রহিম জানিয়েছেন, সুদৃশ্য উত্তরা নগর ভবন নির্মাণ করা হলেও এর কোনো কর্মকাণ্ড নেই। সিটি করপোরেশনের তেমন কার্যক্রম না থাকার কারণে নাগরিক সুবিধা থেকে উত্তরাবাসী বঞ্চিত। ৫ নম্বর সেক্টরে খেলার মাঠ, পার্ক, কমিউনিটি সেন্টার, কাঁচাবাজার নেই বললেই চলে। আজমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে দক্ষিণখান যাওয়ার সময় বোঝা যায় এটি একটি মফস্বল এলাকা। কাদা ও পানির জন্য যানবাহনে চলাচল করতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় সবাইকে। এলাকাবাসী অভিযোগ করার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ৭ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা পার্থ সাহা বলেন, এলাকার সবাই শিক্ষিত-অভিজাত দাবি করলেও এলাকার একমাত্র লেকটি বাঁচানোর জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। উত্তরায় কোনো মন্দির, গির্জা কিংবা প্যাগোডা নেই। মডেল টাউনে বাস করেও অনেকেই বাজার সদাই করছে ফুটপাত থেকে। বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হয় বাড়ির ছাদে। সরকারি কোনো কমিউনিটি সেন্টার নেই। তার ওপর সামান্য একটু বৃষ্টি হলে পুরো উত্তরা তলিয়ে যায়। এলাকাবাসী জানায়, নির্ভেজাল আবাসিক এলাকা হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে ১, ৩, ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের বেশির ভাগের বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গেছে। মৃত্যুর পর দাফনের জন্য মডেল টাউনে কোনো সরকারি কবরস্থান নেই। লাশ নিয়ে আশপাশে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল ও পাঠাগার নির্মাণ করা হয়নি। এসবের জন্য প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে তারা। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে শিল্পপতি সবাই তাকিয়ে থাকেন, কিভাবে দামি প্লট বরাদ্দ পাওয়া যায়। উন্নয়নের ব্যাপারে তাঁদের কোনো নজর নেই। অথচ উত্তরায় মন্ত্রী, এমপি, সরকারের আমলারা বসবাস করে আসছেন। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১৫ নম্বর রোডের বাসিন্দা শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ১০ বছর ধরে এই রোডটি ভাঙাচোরা। বৃষ্টি হলেই এই রোডে ধানের চারা রোপণ করার মতো অবস্থা হয়। কল্যাণ সমিতির লোকজন সবার সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন। তাঁরা নিয়মিত উন্নয়নের টাকা আদায় করছেন। তিনি আরো বলেন, ১৭ নম্বর রোডে একটি আবাসিক ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে ‘রিজেন্ট’ নামে একটি ক্লিনিক। অথচ ভবনের মালিক আবাসিক ভবন হিসেবে রাজউকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন। অভিযোগ আছে, ক্লিনিক গড়ে তোলার জন্য উত্তরা পশ্চিম থানার ওসিসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও কল্যাণ সমিতির কিছু কর্মকর্তা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছেন। এসব অভিযোগ সম্পর্কে ১১ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপ্রতুল : দেশের প্রথম মডেল টাউন হলেও উত্তরায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই পুরো এলাকা তলিয়ে যায়। ১৪টি সেক্টরের সবগুলো ড্রেন একই সঙ্গে নির্মাণ করা হলে আর সমস্যা থাকত না বলে অভিমত এলাকাবাসীর। উত্তরায় এখনো ২০ শতাংশ প্লটে কোনো বাড়িঘর হয়নি। ফলে সেখানকার ড্রেনগুলো কাঁচা অবস্থায় পড়ে থাকে। উত্তরার পূর্ব দিকে রেললাইনের পাশে বেশ কিছু সরকারি নিচু জমি রয়েছে। কিন্তু সেগুলো দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী মহল। ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা করা হচ্ছে। মূলত এ কারণে আবাসিক এলাকা থেকে পানি সরতে পারে না। আর মশার উৎপাত তো রয়েছেই। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা : উত্তরা থেকে মতিঝিলের দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। অথচ সেখানে যেতে-আসতে উত্তরাবাসীর লেগে যায় তিন থেকে চার ঘণ্টা সময়। ৫, ১০, ১১, ১৩ ও ১৪ নম্বর সেক্টর থেকে প্রধান সড়কে যানজটের কারণে গাড়ি বের হতে সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। সকালে স্কুল-কলেজ শুরুর সময়ে পুরো মডেল টাউন একটি বিশাল গাড়ির ভাগাড়ে পরিণত হয়। এর জন্য ফুটপাত দখল এবং বড় বড় বিপণিবিতানে পার্কিং ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা। ১৫তলা এইচ এম প্লাজা, অষ্টম তলা লতিফ এম্পোরিয়ামের নিচে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে কাপড়ের মার্কেট ও রেস্তোরাঁ। কুশল সেন্টারের নিচে পার্কিংয়ের স্থানে কাঁচা ও মুদি বাজারের শত শত দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া রাজউক ট্রেড সেন্টার, আমির কমপ্লেক্সসহ আরো অনেক বিপণিবিতানের পার্কিং নকশায় থাকলেও বাস্তবে নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খতিয়ান : রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আগা খান স্কুল, ইন্টারন্যশনাল টার্কিশ হোপ হাই স্কুল, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ইউনাইটেড কলেজ, এভিয়েশেন সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, আল-হেরা ইসলামিক ক্যাডেট স্কুল, নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা গার্লস হাই স্কুল, উত্তরা টাউন ইউনিভার্সিটি কলেজ, শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, মওলানা ভাসানী মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল প্রভৃতি এ মডেল টাউনে রয়েছে। ক্রাইম জোন উত্তরা : উত্তরা মডেল টাউনের পূর্ব পাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইন, পশ্চিম দিকে হরিরামপুর ইউনিয়ন, উত্তরে তুরাগ নদ এবং দক্ষিণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিন্তু কোনো পাশেই স্থায়ী কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলে। উত্তরাকে অপকর্মের ঘাঁটি বানালেও অপরাধীরা বসবাস করে তুরাগ থানার কামারপাড়া, ধউর, আশুলিয়া, টঙ্গীর বাস্তুহারা, বোর্ডবাজার এলাকায়। বহিরাগত অপরাধী ছাড়াও স্থানীয় মাদকসেবীরা টাকা জোগাড়ের জন্য দামি গাড়ি নিয়ে ছিনতাই করে। তা ছাড়া গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরির অনেক ঘটনা ঘটছে। ফুটপাতে চাঁদাবাজি হচ্ছে দেদার। পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার নিসারুল আরিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, অভিজাত এলাকায় নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অনেক সময় ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও প্রতারণার শিকার হয়েও পুলিশের কাছে আসতে চায় না মানুষ। পুলিশকে বন্ধু হিসেবে সবাইকে ভাবতে হবে। তাহলে যেকোনো সমস্যা সমাধান সহজ হয়। ভিনদেশি অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বাসাবাড়িতে অসামাজিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো আবাসিক ভবনে কেউ ব্যবসা করলে তা দেখবে রাজউক ও সিটি করপোরেশন। পুলিশের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
No comments:
Post a Comment