পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, চেইন অব কমান্ড অমান্যসহ বিস্তর অভিযোগ। সদর দফতরের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তেমন পরিবর্তন হয়নি আচরণগত সমস্যারও। টাকা না পেয়ে নির্যাতন, সাধারণ মানুষকে হয়রানি, দাবিকৃত টাকা না পেয়ে হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, শ্লীলতাহানির মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে অসাধু পুলিশ সদস্য
ের সখ্য গড়ে ওঠায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হলেই ছিনতাই, অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের মুষ্টিমেয় পুলিশ সদস্যের কারণে দেড় লক্ষাধিক সদস্যের বিশাল এ বাহিনীর ইমেজ সংকট কাটছে না। তবে পেশাদার পুলিশ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক বলয়ে থাকা কিছু পুলিশ সদস্যের আচরণের কারণে পুরো বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব সদস্য একের পর এক অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় অন্য পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ক্রমেই অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এ অবস্থায় পেশাদার কর্মকর্তাদের মত হচ্ছে, ‘পুলিশে সংস্কারের পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা উচিত। পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ সম্পর্কে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার যুগান্তরকে বলেছেন, এত বড় একটি বাহিনীতে কিছু দুষ্ট লোক থাকতেই পারে। তবে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতর জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে যোগ দিয়ে পুলিশের পোশাক পরেই এরা নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। ধরা পড়ছেন দুই-চারজন। বাকিরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি কিছু ঘটনা পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। বিশেষ করে পুলিশ হেফাজতে থাকাবস্থায় ব্যবসায়ীর টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এছাড়া সাভার ও মিরপুরে টাকা না দেয়ায় পুলিশ হেফাজতে ব্যবসায়ীকে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের পেশাদারিত্ব নিয়ে। পুলিশের ইমেজ রক্ষায় এ ধরনের ঘটনার তদন্ত শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ পুলিশকে কোনোভাবেই তাদের বিপদে বন্ধু ভাবতে পারছে না। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, নানা অপরাধে গত দেড় বছরে সারা দেশ থেকে ১৩ হাজার ৭৪৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫৬৬ জনের বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। অন্যদিকে গত এক বছরে গুরুতর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন পুলিশের শতাধিক সদস্য। সূত্র জানিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের মধ্যে ৮ জন পুলিশ সুপার, ৩ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ২২ জন সিনিয়র সহকারী সুপার, ৪২২ ইন্সপেক্টর, ৭ হাজার ৩৫ এসআই, ৩ হাজার ৭১৮ এএসআই, ১ হাজার ৩১৫ সার্জেন্ট ও টিএসআই, ২ হাজার ৪৩১ হাবিলদার, ১ হাজার ২১৯ নায়েক ও ৩ হাজার ১৩২ জন কনস্টেবল রয়েছেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ আগস্টের মধ্যে জমা পড়া এসব অভিযোগের সব ইতিমধ্যেই নিষ্পত্তি হয়েছে। সূত্র জানায়, এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মেলায় লঘুদণ্ড দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ২ জন পুলিশ সদস্যকে। এর মধ্যে পুলিশের ১২ হাজার ৯৭২ জন কনস্টেবল ছাড়াও ১৯ জন ইন্সপেক্টর, ৭ জন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি), ১ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) এবং ৩ জন পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। লঘুদণ্ডে শাস্তি হিসেবে পুলিশের এসব সদস্যকে তিরস্কার ছাড়াও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পদোন্নতি এবং বেতন স্থগিত রাখা হয়েছে। অভিযুক্ত এসব কর্মকর্তার মধ্যে অনেকের নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য বেতন স্কেলে দক্ষতাসীমা অতিক্রম বন্ধ, বেতন স্কেলের নিুধাপে অবনমিতকরণ এবং কর্তব্যে অবহেলার জন্য সরকারের আর্থিক ক্ষতির সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ বেতন থেকে আদায় করা হচ্ছে। অন্যদিকে গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত দেড় বছরে শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার ছাড়াও চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে ১২৮ জনকে। তবে যাদের চাকরিচ্যুত কিংবা বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে পুলিশের কনস্টেবল পর্যায়ের সদস্য বেশি। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, ইন্সপেক্টর, সহকারী পুলিশ কমিশনার কিংবা অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর অনেক অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো দণ্ড বা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সদর দফতর সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল) বিধিমালা-১৯৮৫ অনুযায়ী অভিযুক্ত এসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে।
No comments:
Post a Comment