কালো তালিকাভুক্ত করার পরও নির্বিঘ্নে চলছে ছয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। এদের মধ্যে আদালতের নির্দেশে তিনটি ও সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে চলছে বাকি তিনটি । আইনি লড়াইয়ে সরকার হেরে গেলেও আপিলের জন্য আগ্রহ দেখায়নি সংশ্লিষ্টরা। বরং ওই অবস্থাতেই দেয়া হচ্ছে পরিচালনার অনুমতি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বি
ক কার্যক্রম মূল্যায়ন ও সুপারিশের জন্য ২০০৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ৯ সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে। এই কমিটি পরের বছর ২০০৪ সালে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে আটটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। পরে এ কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিতে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। ২০০৪ সালেরই ২ নভেম্বর এই কমিটি আটটির পরিবর্তে ছয়টিকে কালো তালিকাভুক্ত করে প্রতিবেদন দেয়। এই দুই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবরের দিকে সরকার ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। তখন বিশেষ বিবেচনায় একটি মুক্তি পায়। বন্ধ ঘোষিত ৫টি হচ্ছে- সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি এবং কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি। এগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আদেশের বিরুদ্ধে মামলা করে স্থিতাদেশ নিয়ে নিজেদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। আর হাল ছেড়ে দিয়ে শেষ দুটির উদ্যোক্তারা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেন। প্রথম তিনটির মধ্যে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি মামলায় জয় লাভ করে ২০১১ সালের ২১ আগস্ট পরিচালনার আদেশ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে সরকারি তরফে রহস্যজনক কারণে মামলার আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়নি। ফলে বিষয়টি সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির পক্ষে চলে যায়। জানা গেছে, একই প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয়টি বা কুইন্স ইউনিভার্সিটিও পরিচালনার আদেশ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। আর তৃতীয়টির সঙ্গে সরকারের মামলা চলছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি এই অবস্থায় থেকেও সনদ বাণিজ্য হরদম চালিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। শুধু সরকারি হিসাবেই সারা দেশে এদের অন্তত ২২টি অবৈধ ক্যাম্পাস রয়েছে, যেগুলো বন্ধের জন্য সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী মোবাইল ফোনে আলাপকালে যুগান্তরকে বলেন, আইনি লড়াইয়ে জয় লাভ করে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি পরিচালনার আদেশ নিয়েছে। আর কুইন্স ইউনিভার্সিটির ব্যাপারে বলা হচ্ছে যে, এর উদ্যোক্তা বিরোধী দলের সংসদ সদস্য ছিলেন বিধায় তিনি রাজনৈতিক রোষানলে পড়েন। রাজনৈতিক বিবেচনায় তখন তার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। এ কারণে বিষয়টি উদারভাবে দেখা হচ্ছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যে কমিটি উল্লিখিত ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল তারা তখন একই সঙ্গে আরও তিনটিকেও তালিকাভুক্ত করে। সেগুলো হচ্ছে- বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, গ্রীন ইউনিভার্সিটি। এর মধ্যে তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন পরবর্তী তদন্ত কমিটি রহস্যজনক কারণে প্রথম দুটির ওপর থেকে ‘কালিমা’ তুলে নিয়ে পরিচালনার অনুমতি দেয়ার সুপারিশ করে। ফলে এ দুটি সেই যাত্রায় রক্ষা পায়। আর তৃতীয়টি বা গ্রীন ইউনিভার্সিটি অবশ্য সরকার বিশেষ ক্ষমতায় পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে। ফলে কালো তালিকাভুক্ত হলেও এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধের মুখ আর দেখতে হয়নি। কুইন্স ইউনিভার্সিটি : এই ইউনিভার্সিটি সরকার কর্তৃক বন্ধ ঘোষিত হয় ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর। চলতি বছরের ১৪ জুলাই ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, ‘সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট থেকে রিট মামলা নম্বর ৩০৭৮/২০০৮ এর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে যে রায় দেয়া হয়েছে সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলেট ডিভিশনে আপিল করার প্রয়োজনীয়তা নেই বলে কমিশন কর্তৃপক্ষ মনে করে’। এতে আরও বলা হয়, ‘ইতিপূর্বে সেন্ট্রাল উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮৭৩/২০০৭ মামলার রায়ের বিরুদ্ধেও ইউজিসি উচ্চ আদালতে আপিল করেনি এবং কমিশনের সুপারিশক্রমে সরকার তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। অনুরূপভাবে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়কেও তাদের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়ার জন্য কমিশন সুপারিশ করছে।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে কালো তালিকাভুক্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পুনরায় চালু করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে কুইন্স ইউনিভার্সিটিকে পুনরায় পরিচালনার অনুমতি দেয়ার পক্ষে ২০১৩ সালের ২৭ মার্চ ইউজিসি থেকে দেয়া আরেক পত্রে বলা হয়, ‘অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ফজলুল হকের তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের মান সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিচারপতির পুত্র ফোনে হামিদা বানু শোভার কাছে উৎকোচ দাবি করেন এবং বিচারপতি তাকে জাজেস চেম্বারে যাওয়ার অনুরোধ করেন। শোভা নৈতিকতার স্বার্থে বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেননি। যার ফলশ্র“তিতে শোভার বিশ্ববিদ্যালয়কে সাময়িক সনদ না দেয়ার সুপারিশ করেন।’ এই যুক্তিতেও ইউজিসি থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করার কথা বলা হয় এ চিঠিতে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী সালাউদ্দিন আকবর সম্প্রতি যুগান্তরকে বলেন, কুইন্স ইউনিভার্সিটি মামলায় জয় লাভ করেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আপিল করতে বলার পরও ইউজিসি তা করেনি। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও এখন পুনরায় চালুর অনুমতি পেয়ে যাবে। যে কারণে বন্ধ : নথিপত্রে দেখা যায়, ২০০৪ সালে প্রথমে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়কে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল সনদ বাণিজ্য ও সরকারের বিধিবিধান অমান্যসহ বেশ কয়েকটি কারণে। অন্য কারণের মধ্যে রয়েছে- ভৌত অবকাঠামোগত ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি না করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সংরক্ষিত তহবিলে অর্থ জমা না রাখা, লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগতমান সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক বই-পুস্তক ও যন্ত্রপাতি নেই। চাহিদা অনুযায়ী যোগ্য এবং পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ না করা, জুনিয়র শিক্ষক দিয়ে কোর্স পরিচালনা, ইউজিসি অনুমোদিত সিলেবাস সম্পূর্ণ শেষ না করে পরীক্ষা নেয়া, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের পূর্ব অনুমোদন ব্যতীত নতুন বিভাগ ও কোর্স চালু, বোর্ড অব গভর্নরস/বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এবং ভিসিদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং সমন্বয়হীনতা, কোনো কোনোটিতে একদিকে যেমন প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে অন্যদিকে আর্থিক বিধি ও শৃংখলা সঠিক পরিপালন করা হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তখন কালো তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশ কয়েকটি এখন পর্যন্ত এ সমস্যা থেকে উত্তরণ করতে পারেনি। বরং আরও বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে আমেরিকান-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির অবস্থা বেশি নাজুক বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
No comments:
Post a Comment