অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ছিল ১৩০০ সিসির একটি করলা স্টেশন ওয়াগন। যার দাম সোয়া দুই লাখ টাকা। দুটি রঙিন টিভি ও ফ্রিজ আর ১০টা ফ্যান। খাট, সোফাসেট ও ওয়ারড্রবসহ এক লাখ টাকার আসবাবপত্র। স্থাবর সম্পদের মধ্যে ছিল বাড়ি ও পুকুরসহ প্রায় ১৫ বিঘা জমি। স্ত্রী-পুত্রসহ যৌথ নামে আরও ১৫৫ শতক জমি। স্ত্রীর ছিল পাঁচ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। দায়দেনাও ছিল পৌনে এক লাখ টাকা। কৃষি খাত থেকে বার্ষিক আয় মাত্র ২০ হাজার টাকা। ব্যবসা ও শে
য়ার ব্যবসা থেকে আয় বছরে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মাত্র। এমন বিবরণ দিয়ে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইসিতে হলফনামা জমা দেন মহাজোট সরকারের সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস। ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান লতিফ বিশ্বাস নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। শুরু থেকেই অনিয়ম, দুর্নীতি আর সরকারি সম্পদ লুটপাটে নেমে পড়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। অনিয়ম ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে প্রধান হোতা ছিলেন মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিল্টন কুমার সাহা। মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ প্রতিটি দফতরের অশুভ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন এই এপিএস। সব দফতর থেকেই নির্দিষ্ট হারে কমিশন আসত তার কাছে। ফলে মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে হন শত কোটি টাকার মালিক। অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতি আড়াল করতে ফাইলের নোটশিট বদলানো, কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্য, অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেয়াসহ নানা ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত ছিলেন সাবেক এই মন্ত্রী। এসব অনিয়ম তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ হয়েছে উপেক্ষিত। দুদকও রহস্যজনক কারণে তদন্ত থেকে সরে এসেছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় তৈরি করেছেন ৭ তলা বাড়ি। নিজ এলাকার শত শত বিঘা জমি ক্রয়সহ নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন মন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা। মন্ত্রণালয় ও যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব তথ্য। দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে মঙ্গলবার দুপুরে মোবাইল ফোনে সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাবস্থায় আমি কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি করিনি। আমার দফতরের কেউ দুর্নীতি করেছে এমন অভিযোগও কেউ করেনি। কিছু বিষয় নিয়ে সচিবের সঙ্গে সমস্যা থাকায় তিনি নানা ধরনের অপপ্রচার করেছেন। তাছাড়া দুদকে অভিযোগ করলেও তারা তা খুঁজে পায়নি। এতেই প্রমাণ হয় আমি নির্দোষ। চিড়িয়াখানার দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওখানে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি। চিড়িয়াখানায় কোনো নিয়োগ বা কাজ এমপি আসলামের লোক পেলে ইলিয়াস মোল্লার লোকজন বলে দুর্নীতি হয়েছে। আবার ইলিয়াসের লোক পেলে আসলামের লোক বলে অনিয়ম হয়েছে। দুর্নীতি ঢাকতে নোটশিট বদল : অনিয়ম ও দুর্নীতি চাপা দিতে মন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ফাইলের নোটশিট পরিবর্তন করা হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তা আবু সাঈদ কামাল বাচ্চু ও অসীম কুমার দাসের দুর্নীতি তদন্ত করতে ২০১২ সালের ১৫ মে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল হক মোল্লা নথি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। নথিতে সংশ্লিষ্ট উপসচিব থেকে শুরু করে অতিরিক্ত সচিব কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে সচিবের কাছে পেশ করা হয়। সচিব নোটানুচ্ছেদ-৭১-এ নোটানুচ্ছেদ-৭০-এর প্রস্তাব অনুমোদনসহ জমি সংক্রান্ত বিষয়টি ভূমি রেকর্ড অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে পত্র দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে নথিটি ২০ মে তৎকালীন মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাসের কাছে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মন্ত্রী সে প্রস্তাব অনুমোদন না করে সচিবকে দিয়ে নথি থেকে অসীম ও কামাল বাচ্চুর নাম বাদ দিয়ে নথি অনুমোদন দেন। কেনাবেচায় কমিশন বাণিজ্য : লতিফ বিশ্বাসের আমলে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও এর আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে বাজারদরের চেয়ে অধিক মূল্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ওষুধ, বোতল, হ্যান্ড গ্লোবসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ আদেশ দিতে দরপত্রে জালিয়াতি, নামমাত্র প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই), মালামাল বুঝে না পেয়েও বিল পরিশোধ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে মেসার্স যমুনা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ৯ মে উপসচিব মোঃ খায়রুল ইসলাম শেখ উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়ার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন। অজ্ঞাত কারণে এর সঠিক তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া অ্যানথ্রাক্স প্রকল্পের জন্য বাজারে ৬০ টাকার গ্লিসারিন ৪৯০ টাকা দরে কেনা হয়। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির স্প্রে কার্যক্রমের আওতায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৫০০ স্প্রে মেশিন কেনা হয়েছিল। বাজার মূল্য ৫০০ টাকা হলেও তা ১৮৪০ টাকা দরে কেনা হয়েছিল। মহাখালীর প্রাণিসম্পদ গবেষণাগারে রক্ষিত ৮০ লাখ টাকার মালামাল কোনো নিয়ম-কানুন ছাড়াই মাত্র ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট একটি চক্র। এতে মেরামতযোগ্য ৮০টি অত্যাধুনিক ফ্রিজ, ডিপফ্রিজ, ৫০টি এয়ারকুলার, ইনকিবিউটর, অটো ফিলিং মেশিন, ডায়িং প্লান্টসহ আট ট্রাক বোঝাই ৮০ লাখ টাকার মালামাল মাত্র ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। এসব মালের ভেতর অনেক ব্যবহারযোগ্য মালও ছিল। প্রকাশ্য নিলাম না করায় সরকারের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় গত বছরের ২০ ফেব্র“য়ারি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দেলোয়ারা বেগম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের কথা বলা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই প্রতিবেদনের কোনো সুরাহা হয়নি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরে যোগাযোগ করা হলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। চিড়িয়াখানার দুর্নীতি : ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকেও বিশাল অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য চলত সাবেক প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর নামে। মেসার্স আলম ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছিল- এলটিএমের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার মালামাল ক্রয় দেখিয়ে সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর আগে সংসদীয় কমিটি চিড়িয়াখানায় নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় ডেপুটি কিউরেটর ডা. শহীদুল্লাহ ও প্রকৌশলী মতিউর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করার জন্য সুপারিশ করেছিল। কিন্তু দুজনের সঙ্গেই মন্ত্রী ও তার এপিএসের সখ্য থাকায় সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। নিয়োগে দুর্নীতি : মন্ত্রণালয়সহ এর অধীন সব অধিদফতরের প্রতিটি নিয়োগে ছিল লতিফ বিশ্বাসের বাণিজ্য। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে চতুর্থ শ্রেণীর জনবল নিয়োগে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। অধিদফতরের সাবেক ডিজি আশরাফ আলী ও ডা. মোসাদ্দেক হোসেনের সময় সমচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। মন্ত্রীর আশীর্বাদ থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশও উপেক্ষিত : এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করতে ২০১২ সালের ২৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক আফরোজা পারভীন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এবং তদন্তের অগ্রগতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করারও নির্দেশ দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ডিজিকে একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ে তলব করা হলেও মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কারণে তা আর বেশিদূর যেতে পারেনি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। অভিযোগ পেয়েও নিশ্চুপ দুদক : গত ফেব্র“য়ারি মাসে সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ খতিয়ে দেখার অনুমোদন দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালাহউদ্দিনকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। দুদক সূত্র জানায়, আবদুল লতিফ বিশ্বাস নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় সম্পদের যে বিবরণ দিয়েছেন তার সঙ্গে আয়কর নথিতে উল্লিখিত সম্পদের তথ্যে গরমিল রয়েছে। এছাড়া তিনি মন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করে অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন- মর্মেও অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) সাহাবুদ্দিন চুপ্পু যুগান্তরকে বলেন, লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটিতে আছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না দাবি করে এপিএস হিল্টন কুমার সাহা শুক্রবার মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমার নিয়োগটাই ছিল রাজনৈতিকভাবে। আমার কাছে লোকজন আসত বিভিন্ন তদবির নিয়ে। এপিএস হিসেবে আমার যেটা দায়িত্ব আমি সেটুকুই পালন করেছি।
No comments:
Post a Comment