কোনো ধরনের শাস্তির বিধিবিধান না রেখেই প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে ‘শিক্ষা আইন’। নোট-গাইড এবং প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং, ছাত্রীদের যৌন হয়রানি, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, একীভূত পাঠ্যবই প্রবর্তন, তিন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা রেখে মোট ৬৭টি ধারা সংযুক্ত হয়েছে এই আইনে। কিন্তু এসবের ব্যত্যয় ঘটলে বা কেউ যদি নির্দেশিত বিষয়গুলো না মানেন, তাহলে তার কী হবে- স
েসবের কোনো নির্দেশনা নেই এতে। এভাবে শাস্তির কোনো বিধান না থাকায় এটি একটি অকার্যকর আইনে পরিণত হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘শাস্তির বিধান ছাড়া আইন হতে পারে। তবে সেটা আর আইন থাকে না। এর প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নও হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যদি রাস্তায় গিয়ে এ কথা জিজ্ঞেস করেন, তাহলে ৯৯ ভাগ মানুষই একথা বলবে যে, এ আইন কার্যকর হবে না। আইন করলে তাতে শাস্তির বিধান থাকতে হবে।’ সরকার যে ‘শিক্ষা আইন’ করতে যাচ্ছে তা হবে দেশের ইতিহাসে প্রথম। কিন্তু প্রস্তাবিত ওই আইনে বেশকিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। সর্বশেষ যে খসড়াটি চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছিল, সেটি নানা সংকীর্ণতা ও অসম্পূর্ণতায় ভরপুর। এমনকি এতে দ্বৈত প্রশাসন ব্যবস্থা তৈরির পথও রয়েছে। পাশাপাশি স্কুল পরিচালনা পর্ষদ, এমপিও বণ্টন, প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতির রাস্তা রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। নেই এযাবৎকালে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রয়োজনে যেসব আইন ও বিধিবিধান তৈরি হয়েছে, সেগুলোর কোনো প্রতিফলন ও সমন্বয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খসড়াটি আইনের পরিবর্তে অনেকটা মন্ত্রণালয়ের চলমান কার্যক্রমের ‘সমন্বিত বিবরণী’ ও ‘শিক্ষানীতি’র মতো হয়েছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে বিভিন্ন বিষয় যেভাবে স্থান পেয়েছে, অনেকটা সেভাবে রয়েছে। এক কথায় আইন এবং নীতিকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। আইনের অধীনে যারা অংশীজন (স্টেকহোল্ডার), তাদের খুশি করার প্রবণতা এতে এতই, অনেকটা যে যা চেয়েছেন তাই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন- ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত আইনে ‘গাইড ও নোটবই’ সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থার বিধান ছিল- যা তুলে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের নানা ধরনের দুর্নীতির জন্য একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়ী। এসব রোধের পথও বন্ধ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে আইনে প্রশাসনিক স্বার্থে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তঃশিক্ষা বোর্ডে বদলির যে নির্দেশনা ছিল, তা তুলে ফেলা হয়েছে। কেউ যদি প্রশ্ন ফাঁস করেন বা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলাসহ সমন্বিত পাঠ্যপুস্তকের বিষয়টি না মানলে অথবা কেউ যদি শিক্ষার তিন স্তর না মানতে চান তাহলে তার কী হবে- সে নির্দেশনাও নেই। এ ব্যাপারে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ার ৬৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- ‘(১) ... এই আইনের কোনো ধারা বা উপধারার পরিপন্থী ও শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করিলে তা সরকারের/কর্তৃপক্ষের বৈধ আদেশ অমান্য বলিয়া গণ্য হইবে এবং সরকার সেই ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত আইন/বিধি/বিধানের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’ (২) এই আইনের কোনো ধারা বা উপধারার পরিপন্থী কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হইলে এবং তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হইলে দেশে প্রচলিত আইন মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’ অথচ এই আইনের ইতিপূর্বের খসড়ায় ‘এই আইন’ লংঘনে ধারা বিশেষে সর্বনিু ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা আর সর্বনিু ৬ মাস থেকে ১ বছর জেল অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের শেষের দিকে সরকার যখন ব্যাপক চাপের মুখে ছিল বিশেষ করে সামনে জাতীয় নির্বাচন ছিল, তখন শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের দাবির মুখে শাস্তির বিধানটি তুলে দেয়। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের দাবি অনুযায়ী বিভিন্ন ধারায় পরিবর্তন এনে একে ‘নখদন্তহীন’ একটা আইনে পরিণত করেছে। ফলে এ আইন করা আর না করা সমান বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে এ ধরনের আইন রয়েছে এবং তাতে শাস্তিরও বিধান রয়েছে। নাম প্রকাশ না করে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আইনবিজ্ঞান কখনোই শাস্তি ছাড়া আইনকে স্বীকার করবে না। আর পৃথিবীর কোনো দেশে এ ধরনের শাস্তিবিহীন আইনেরও অস্তিত্ব মিলবে না।’ জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (অডিট ও আইন) মোঃ রফিকুজ্জামান বলেন, বর্তমানে যে খসড়াটি রয়েছে সেটি স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত করা। এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে এর ওপর বেশকিছু বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, চলতি মাসের মধ্যে আইনের ওপর আরেকটি কর্মশালার আয়োজন করা হবে। এরপর তা অনুমোদনের জন্য আবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। শিক্ষার তিন স্তর : খসড়া আইনে আছে, প্রাথমিক হবে অষ্টম শ্রেণী, মাধ্যমিক হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। এরপর উচ্চশিক্ষা স্তর। পাণ্ডুলিপি এনসিটিবির অনুমোদন সাপেক্ষে নোট-গাইড বাদে যে কোনো গ্রন্থ প্রকাশের সুযোগ রাখা হয়েছে। এই স্তরের শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি জাতীয় শিক্ষাক্রম নীতি কাঠামো প্রণীত হবে। শিক্ষার্থী-শিক্ষকের অনুপাত হবে ৩০ : ১। মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমের পরিচালনা করা যাবে। তবে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকার বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়গুলো পড়াতে হবে। উচ্চশিক্ষা স্তরে বর্তমানে বিশেষায়িত সব শিক্ষাই থাকবে। মাদ্রাসায় ৩ বছর মেয়াদি ফাজিল ও ২ বছর মেয়াদি কামিল বা ৪ বছর মেয়াদি ফাজিল অনার্স আর ১ বছর মেয়াদি কামিল থাকবে। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে এটা বাস্তবায়িত হবে। মেডিকেল শিক্ষার জন্য ‘মেডিকেল অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠন করা হবে। কৃষি শিক্ষার জন্য ‘সমন্বিত মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি’ থাকবে। আইন কলেজের শিক্ষার মান নিশ্চিতে বার কাউন্সিল ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে ‘বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক কমিটি’ থাকবে। বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন’ থাকবে। সরকারি-বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান নির্ণয়ে ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ থাকবে। শিক্ষক নিয়োগের জন্য বর্তমান ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’ বাতিল করে ‘বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কমিশন’র কথা রয়েছে। ন্যূনতম গ্রাজুয়েট বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাগবে এ স্তরের শিক্ষক হওয়ার জন্য। পাশাপাশি নতুন শিক্ষকদের ৫ বছরের মধ্যে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের জন্য বর্তমান ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’ বাতিল করে ‘বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কমিশন’র কথা রয়েছে। ন্যূনতম গ্রাজুয়েট বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাগবে এ স্তরের শিক্ষক হওয়ার জন্য। পাশাপাশি নতুন শিক্ষকদের ৫ বছরের মধ্যে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। যেহেতু ৮ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা থাকবে, তাই যেসব স্কুল পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, সেগুলোতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত খোলা হবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী খোলা হবে। আর কলেজে খোলা হবে নবম-দশম শ্রেণী। যদি কোনো কলেজে অনার্স বা ডিগ্রি থাকে, তাহলে তারা কেবল স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাদান করবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের জন্য থাকবে আচরণবিধি। নবম বা একাদশ শ্রেণীতে ভর্তিতে কোনো পরীক্ষা নেয়া যাবে না।
No comments:
Post a Comment