বর্ষা মৌসুম শেষে শুরু হওয়া ভারী বর্ষণ ও সেই সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় দেখা দেওয়া বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। এদিনও দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের জোরালো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এদিকে গতকাল আবহাওয়ার পূর্বাভাসের খবরে বাসস জানায়, আগামী ৭২ ঘণ্টায় গঙ্গা-পদ্মা ও ঢা
কা শহরসংলগ্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা তথ্যকেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে খবরে আরও বলা হয়, পাউবোর ৮৩টি পানি মনিটরিং স্টেশনের মধ্যে ৪৪টি স্থানে পানি বেড়েছে। ১২টি স্থানে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার দুটি ইউনিয়নের সাতটি গ্রামে দ্বিতীয় দফায় দেখা দিয়েছে বন্যা। গতকাল সকাল থেকে নদীর পানি বাড়তে থাকলে এসব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ আবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। কোলকোন্দ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মমিনুর ইসলাম জানান, প্রথম দফায় বন্যার পানি বুধবার নেমে গেলেও গতকাল সকাল থেকে নতুন করে পানি বাড়তে থাকে। একই উপজেলার লক্ষ্মীটারি ইউপি চেয়ারম্যান ফয়সাল হাসান বলেন, প্রথম দফার বন্যায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর ফের বন্যা শুরু হওয়ায় মানুষজন আরও অসহায় হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত তিনটি উপজেলা-গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছার দুর্গত লোকজনের মধ্যে সাত টন চাল ও ১০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। গাইবান্ধায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও গত ২৪ ঘণ্টায় সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে তিস্তার পানি ২ সেন্টিমিটার বেড়েছে। ঘাঘট নদের পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। পানির চাপে শহর রক্ষা বাঁধের পাঁচটি পয়েন্ট হুমকিতে পড়েছে। এরই মধ্যে সদর উপজেলার পশ্চিম কোমরনই এলাকায় এ বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁশের পাইলিং করে ও বালুর বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছে পাউবো। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে খাওয়ার পানি ও জ্বালানির সংকট। সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। গতকাল দুপুরে শহর রক্ষা বাঁধের হার্ডপয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অভ্যন্তরীণ নদী করতোয়া, বড়াল, ইছামতী ও ফুলঝোড়ের পানিও বাড়তে শুরু করেছে। দেখা দিয়েছে তীব্র নদীভাঙন। চারণভূমি তলিয়ে যাওয়ায় দুগ্ধশিল্পসমৃদ্ধ এ জেলার শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলার প্রায় ১২টি ইউনিয়নের দুগ্ধখামারিরা পড়েছেন বিপাকে। নদীভাঙনের কারণে ইতিমধ্যে স্থানান্তর করা হয়েছে চৌহালী উপজেলার থানা ভবন। গতকাল ভোরে এ ভবন ও উপজেলার সরবরাহকাজে নির্মিত ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। থানা ভবনটি স্থানান্তর করা হয়েছে চৌহালী ডিগ্রি কলেজ ভবনে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিও হুমকির সম্মুখীন। কমপ্লেক্স থেকে নদী ২০ হাত দূরে অবস্থান করছে। গত দুই দিনে নদীতীরবর্তী এলাকার দেড় শতাধিক বাড়ি ও তিন শতাধিক বিঘা জমি বিলীন হয়ে যায়। জেলা প্রশাসক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, পাঁচটি উপজেলায় ৫২ মেট্রিক টন চাল ও ৪০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে যমুনা, ঝিনাই ও সুবর্ণখালী নদীর পানি অস্বাভাবিক বেড়ে বন্যার অবনতি হয়েছে। শুরু হয়েছে যমুনা নদীর ভাঙন। যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে তারাকান্দি-ভূঞাপুর সড়ক বাঁধ। ঝুঁকি নিয়েই এর ওপর দিয়ে চলছে যানবাহন। এলাকার লোকজন রাত জেগে বাঁধটি পাহারা দিচ্ছেন। এটি রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। গত দুই দিনে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৩০টি গ্রামের এক হাজার তিন শর বেশি পরিবার। বন্যাদুর্গতরা ত্রাণ না পেয়ে কাটাচ্ছে মানবেতর জীবন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. রকিবুল ইসলাম বলেন, পরিবারগুলোর জন্য চার মেট্রিক টন চাল বরাদ্দের পত্র পাওয়া গেছে। নীলফামারীতে তিস্তার পানি গতকাল বিকেলে বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সকালে ডালিয়ায় অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তাবেষ্টিত ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার প্রায় ১৫টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। কুড়িগ্রামেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ অব্যাহত থাকায় জেলার ৪০টি ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দী রয়েছেন। দুধকুমার নদের অব্যাহত ভাঙনে বঙ্গসোনাহাট স্থলবন্দর সেতুর সংযোগস্থল এখন বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে। যেকোনো মুহূর্তে নদীতে ধসে পড়তে পারে সেতুর পশ্চিম অংশ। ঝুঁকি এড়াতে স্থানীয় প্রশাসন সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে গেছে নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের ৩০টি পরিবার। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় গতকাল দুপুরে ভাগ্যকূল গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মার পানি বেড়ে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানিতে তলিয়ে গেছে উপজেলার দৌলতদিয়া, উজানচর ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের নিচু এলাকা। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক শ পরিবার। দেবগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান আতর আলী সরদার বলেন, এ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে সরে গেছে শতাধিক পরিবার। বগুড়ার ধুনটে যমুনার পানি গতকাল বিপৎসীমার ৬৬টি সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বেড়েছে বাঙ্গালী নদীর পানিও। উপজেলার প্রায় ১২টি গ্রামের তিন হাজার পরিবার এখন পানিবন্দী। বন্যাদুর্গতদের মধ্যে গতকাল বিতরণ করা হয় ১৫ মেট্রিক টন চাল। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার পাশাপাশি দেখা দিয়েছে নদীভাঙনও। {প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন: নিজস্ব প্রতিবেদক; রংপুর, কুড়িগ্রাম ও সিরাজগঞ্জ এবং নীলফামারী, গাইবান্ধা, সরিষাবাড়ী (জামালপুর), গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) ও ধুনট (বগুড়া) প্রতিনিধি}
No comments:
Post a Comment