জাহাজ নির্মাণপ্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ড ও স্লিপওয়েজকে বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে সাতটি ব্যাংকসহ ১৪ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এতে তাদের প্রায় এক হাজার ৬৫০ কোটি টাকা আটকে আছে। এই অর্থ আদায়ও করতে পারছে না, আবার আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে খেলাপিও বলতে পারছে না। আনন্দ শিপইয়ার্ডের মূল প্রতিষ্ঠান আনন্দ গ্রুপের অনিয়ম আরও আছে। জাহাজ রপ্তানি নিয়ে তারা ব্যাংকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ-সুবিধা নিয়েছে। আবা
র জাহাজ রপ্তানির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে নেওয়া বন্ড-সুবিধারও অপব্যবহার করেছে। গ্রুপটির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এনবিআর এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তাদের অনুসন্ধানেই এসব অনিয়মের তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশের জন্য জাহাজ রপ্তানিকে অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত বলা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়েছে। কিন্তু জাহাজ রপ্তানির নামে নানা অনিয়মের কারণে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে বলে জাহাজ রপ্তানিকারকেরা বলছেন। ব্যাংকের পাওনা ১৬৫০ কোটি টাকা: ব্যাংকসহ মোট ১৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এক হাজার ৬৪৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেনি আনন্দ গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আনন্দ গ্রুপের মোট নগদ বা ফান্ডেড দায় এক হাজার ২৩৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং নন-ফান্ডেড দায় ৪০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস সূত্র জানায়, আনন্দ ১০টি বড় জাহাজ রপ্তানি বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। এসব জাহাজ রপ্তানির আদেশ বাতিল হলেও তারা ব্যাংককে জানায়নি। অথচ তার পরও ঋণ দেওয়া হয়েছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে এভাবে ঋণ দেওয়ায় ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ব্যাখ্যা জানাতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদসহ এখন ইসলামী ব্যাংকের মোট পাওনা সবচেয়ে বেশি, ৭৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ ছাড়া, মার্কেন্টাইল ব্যাংক আনন্দ গ্রুপের কাছে পাবে ২২১ কোটি ২০ লাখ টাকা, জনতা ব্যাংক ২৩৮ কোটি আট লাখ টাকা, এবি ব্যাংক ১৮৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ওয়ান ব্যাংক ১১৪ কোটি ২১ লাখ টাকা, বিডিবিএল ২৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং এনসিসিবিএল পাবে ১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসিএল আনন্দ গ্রুপের কাছে পাবে এক কোটি ৯৪ লাখ টাকা, এফআইসিএল ২৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা, এফএফআইসিএল ১১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, আইডিএলসি তিন কোটি ৭২ লাখ টাকা, এনএইচএফআইসিএল দুই কোটি ৯৪ লাখ টাকা, হজ ফিন্যান্স কোম্পানি তিন কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং পিএলএফএল পাবে তিন কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক আনন্দ গ্রুপের অনিয়মের বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, পাওনা টাকার বড় অংশ অনিয়মিত হলেও খেলাপি হিসাবে শ্রেণিভুক্ত করা যাচ্ছে না। কারণ, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আনন্দ গ্রুপ ঋণের অর্থ পরিশোধ না করে আদালতের আশ্রয় নেওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাওনা টাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে এর বিপরীতে নিয়মানুযায়ী প্রভিশন বা সঞ্চিতি রাখতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এসব বিষয়ে গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, আনন্দ শিপইয়ার্ডের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিদেশ থেকে আটটি জাহাজ নির্মাণের জন্য কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু সেই জাহাজ রপ্তানি করতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে নির্মিত ও নির্মাণাধীন সব জাহাজ এবং সব ধরনের কাঁচামাল ব্যাংকের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজের দাম বাড়লে, এগুলো বিক্রি করে ব্যাংকের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া হবে। এতে লাভ থাকবে বলেই আশা করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও কাঁচামাল আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি দুদকও অনুসন্ধান করছে। দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, উপযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতেই জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীকে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বন্ড-সুবিধার অপব্যবহার: জাহাজ রপ্তানির নামে বন্ড-সুবিধা পেয়ে আমদানি করা কাঁচামাল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছে আনন্দ গ্রুপ। এই সুবিধার ফলে আমদানিতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, আনন্দ শিপইয়ার্ড ২০০৮ সালে ডেনমার্কে দুটি জাহাজ, মোজাম্বিকে তিনটি ছোট জাহাজ ও মালদ্বীপে দুটি কাঠের জাহাজ রপ্তানির কাজ পায়। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। এর পরেই জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠান বড় ১০টি জাহাজ তৈরির জন্য আনন্দের সঙ্গে চুক্তি করে। এ জন্য আনন্দ বন্ড লাইসেন্স নেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। তবে সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় জার্মান প্রতিষ্ঠানটি চুক্তি বাতিল করে দেয়। কিন্তু এ তথ্য গোপন করে ২০১০ সালে আনন্দ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) একটি টাগ বোট ও দুটি ক্রেন বোট তৈরির জন্য ৪৮ কোটি টাকার কাজ হাতে নেয়। এ কাজের যাবতীয় কাঁচামালও বন্ড-সুবিধার মাধ্যমে দেশে আনে। পরে বিআইডব্লিউটিএর আরও ১৫০ কোটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৬০০ কোটি টাকায় নয়টি ড্রেজার, টাগ বোট, হাউস বোট ও পাইপলাইন নির্মাণের কাজ পায়। এগুলো এখনো শেষ করতে পারেনি আনন্দ। এভাবে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এ নিয়ে অনুসন্ধান করছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে দুই দফায় আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডিকে তলব করা হলেও তাঁরা আসেননি, বরং সময়ের আবেদন করেছেন। তাঁরা দুজনেই দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে আছেন। সব অভিযোগ নিয়ে কথা বলার জন্য আনন্দ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক তারেক ইসলামকে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে, তাঁর পক্ষে আনন্দ শিপইয়ার্ড ও স্লিপওয়েজ লিমিটেডের উপদেষ্টা শেখ সাজিদ ই-মেইলে একটি উত্তর দিয়েছেন। এতে সব অভিযোগ ভুয়া ও ভিত্তিহীন দাবি করে তিনি বলেছেন, আনন্দ গ্রুপ কোনো দিন বন্ড লাইসেন্সের অপব্যবহার করেনি এবং বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গেও জড়িত নয়।
No comments:
Post a Comment