Thursday, September 4, 2014

যমুনায় টানেলের স্বপ্ন:কালের কন্ঠ

৫১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা নদীর তলদেশে সড়ক ও রেলের জন্য টানেল নির্মাণের স্বপ্ন দেখছে সেতু বিভাগ। ১২ কিলোমিটার লম্বা এ টানেল নির্মাণকাজ ২০২১ সালের মধ্যেই শেষ করতে চায় বিভাগটি। পূর্ব পাশে জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ থেকে পশ্চিমে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি পয়েন্ট পর্যন্ত এ টানেল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় বা পরিকল্পনা কমিশনের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ প্রক
ল্পের কোনো নাম-গন্ধ নেই। এমনকি এ টানেল নির্মাণ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও ছিল না। এ অবস্থায় কোনো রকম সমীক্ষা ও পরিকল্পনা ছাড়াই দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল যোগাযোগ অবকাঠামোর এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ খুঁজতে পরিকল্পনা কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছে সেতু বিভাগ। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা অবশ্য সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই না করে এ ধরনের প্রকল্প নিয়ে চিন্তা করাকে ‘সময়ের অপচয়’ বলে মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, যমুনা নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রকল্পটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে কেবল আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ও টানেলের দৈর্ঘ্য এখনো চূড়ান্ত নয়। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ প্রকল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তা দেশের অর্থনীতিতে কেমন ভূমিকা রাখবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সমীক্ষা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্প্রতি জাপান সফরের সময় বাংলাদেশে একটি টানেল নির্মাণে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে ওই দেশের সরকার। মূলত জাপানি ওই বিনিয়োগ আগ্রহকে কাজে লাগানোর জন্যই যমুনা নদীর তলদেশে এ টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ‘কনস্ট্রাকশন অব মাল্টি-মোডাল রোড-রেল টানেল আন্ডার দ্য রিভার যমুনা’ শিরোনামে সেতু বিভাগের তৈরি করা প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (পিডিপিপি) প্রকল্প সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ টানেল গাইবান্ধা ও জামালপুর জেলাকে সংযুক্ত করবে। ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ টানেল নির্মাণে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৫০ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন সহযোগী দেশ জাপানের কাছ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার আশা করা হয়েছে। বাকি ১০ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে সেতু বিভাগ। পিডিপিপিতে বলা হয়েছে, টানেলটি নির্মাণ করা হলে দেশের বিদ্যমান পরিবহন ব্যবস্থা আরো উন্নত হবে। এটি ভ্রমণকে আরো সংক্ষিপ্ত ও সহজতর করবে। ভবিষ্যতে এটি দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পণ্য ও মালামাল উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পরিবহনের পথ সহজ করবে। সর্বোপরি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে এ টানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেতু বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে জাপানি বিনিয়োগ পাওয়াটাই এ প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। কারণ গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে সড়ক ও রেল যোগাযোগ উন্নয়নে বাংলাদেশে একটি টানেল নির্মাণের প্রস্তাব দেন। ওই সময় তিনি শেখ হাসিনাকে বলেন, বাংলাদেশ টানেল নির্মাণে আগ্রহী হলে জাপান সরকার সেখানে বিনিয়োগ করবে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর এমন আগ্রহের প্রেক্ষাপটেই সেতু বিভাগ যমুনা নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কথা চিন্তা করে পিডিপিপি প্রণয়ন করেছে। এ প্রকল্প প্রস্তাব দেখিয়ে জাপানি প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানোর অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে সেতু বিভাগ। কিন্তু সেতু বিভাগের এ প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, জাপান সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর আগে এ প্রকল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু, সে বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ ও সে অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলনসহ সম্ভাব্যতা যাচাই করে যথাযথভাবে ব্যয় নির্ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাতে সেতু বিভাগকে পরামর্শ দিয়েছে কমিশন। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগ না দিয়ে বিপুল অঙ্কের নয়া প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করায় সেতু বিভাগের সমালোচনা করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, সেতু বিভাগের এমন প্রস্তাব পাওয়ার পর তাঁরা বিস্মিত হয়েছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, দ্বিতীয় যমুনা সেতুসহ সরকারের অনেক অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। সেখানে এ ধরনের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করা সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ছাড়া সেতু বিভাগেরই অগ্রাধিকার চারটি প্রকল্প- রাজধানীর জাহাঙ্গীর গেট এলাকায় ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ, যমুনা নদীর ওপর থাকা বঙ্গবন্ধু সেতুর দুই পাড় চার লেনে উন্নীতকরণ, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজই যেখানে শুরু করা যায়নি, সেখানে নতুন করে ৫১ হাজার কোটি টাকার ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া অযৌক্তিক। কমিশনের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণ যে গুরুত্ব বহন করে, যমুনা নদীর নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণের প্রস্তাব কোনোমতেই সমান গুরুত্ব বহন করে না। কেননা, আগামী ১০ থেকে ২০ বছরে জামালপুর, গাইবান্ধাসহ ওই অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে খুব বেশি অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই যমুনা নদীর ওই স্থানে বা বর্তমান সময়ে যমুনা নদীর অন্য কোনো অংশে টানেল নির্মাণের মতো বিলাসী প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়ার বিপক্ষে মত দিয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে সেতু বিভাগের সচিব বলেন, এখনো প্রস্তাবিত প্রকল্পের কোনো সমীক্ষা করা হয়নি। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ ও পশ্চিমে গাইবান্ধা জেলার যমুনা নদীর অংশে এ টানেল নির্মাণের প্রাথমিক চিন্তাভাবনা চলছে। তবে এটি চূড়ান্ত নয়। কেননা যমুনা নদীর ভাঙন ও নাব্যতার বিষয়টি চিন্তার বিষয়। এ ছাড়া এখনো পরিবেশ অধিদপ্তরেরও মতামত নেওয়া হয়নি। খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ টানেল নির্মাণের দিকে ঝুঁকছে। কারণ সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। অধিকৃত ওই সব এলাকার পরিবারগুলোকে সঠিকভাবে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই আমরাও ভবিষ্যতে সেতু নির্মাণের বদলে নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করব। তবে যমুনা নদীর টানেল নির্মাণের যে ব্যয় ধরা হয়েছে, সেটি সঠিকভাবে করা হয়নি বলে স্বীকার করেন সচিব।

No comments:

Post a Comment