দুর্নীতি-অনিয়মের বিচার করেন যাঁরা, তাঁদের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এরই মধ্যে তিন বিচারকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। এ তিন বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থপাচারের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ মিলছে বলেও দুদক সূত্রে জানা গেছে। এর আগে দুজন বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও হয়েছে। আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
জমেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই দুদক এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। দুদক সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি জজ আদালতের তিন বিচারকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতির অভিযোগ এলে কমিশন সেগুলো যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই মধ্যে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে, দুর্নীতির টাকায় ওই বিচারকরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাঁদের ওপর মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করে, সেই বিচারকদেরই কেউ কেউ নানা ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। ইতিমধ্যে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তিন বিচারকের ব্যাপক দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে বাড়ি-গাড়িসহ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তাঁরা।’ অধিকতর অনুসন্ধানে আরো দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসবে বলেও তিনি জানান। সূত্র মতে, ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের সাবেক বিচারক মোতাহার হোসেন এবং ঢাকার বিশেষ দায়রা জজ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক ফারুক আহাম্মদের বিষয়ে অনুসন্ধান টিম গঠন করার পর গত মাসে যুগ্ম জেলা জজ আবুল হোসেন খন্দকারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে তাঁর বিরুদ্ধে আসা সুনির্দিষ্ট অভিযোগটি যাচাই-বাছাই করেই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুদকের উপসহকারী পরিচালক এ কে এম ফজলে হোসেনকে। অনুসন্ধান করে শিগগিরই প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিতে বলা হয়েছে তাঁকে। ঢাকার নবাবগঞ্জের কলাকোপায় ইছামতি নদীর তীরে প্রাসাদোপম একটি বাড়ি। প্রায় দেড় শ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে কারুকার্যময় এ বাড়িটি নির্মিত। জমিদার ব্রজেন রায় ওরফে সুদর্শন রায়ের তৈরি করা বাড়িটি এলাকায় ‘ব্রজ নিকেতন’ নামেই পরিচিত ছিল। চার একর ৫৭ শতক জমির ওপর তৈরি বাড়িটি এখন হয়ে গেছে ‘জজবাড়ি’। অভিযোগ উঠেছে, বিচারক আবুল হোসেনের দুই ভাইসহ (একজন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য) ওই পরিবারের সদস্যদের দখলে আছে পুরো জমিদার বাড়িটি। দেড় শ বছরের পুরনো জমিদার বাড়িটি তাঁরা জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেদের নামে লিখিয়ে নেন এবং ভোগদখলে রাখেন। এ ছাড়া জানা আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগও রয়েছে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে। স্থানীয় ভূমি অফিস ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জমিদারের বংশধরদের মধ্যে সর্বশেষ ওয়ারিশ ছিলেন মানিক রায়ের ছেলে মধুসূদন রায়, মোদক রায়ের ছেলে শ্যামলাল রায়, হরেকৃষ্ণর ছেলে কানাইলাল সাহা ও মোহন সাহা। ভারত বিভক্তির পর জমিদারবাড়ির লোকজন চলে যান ভারতে। সিএস রেকর্ডভুক্ত মালিক ভূমি অধিকারী জমিদার হওয়ায় এবং তাঁর বংশের কোনো মালিক অবশিষ্ট না থাকায় নিয়মানুযায়ী বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি বা ভিপি সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। ভূমি অফিস আরো বলছে, চার একর ৫৭ শতক জমির বাড়ির অংশটুকু জাল রেকর্ডপত্র তৈরির মাধ্যমে বে-আইনিভাবে দখল করে রেখেছেন যুগ্ম জেলা জজ আবুল হোসেন খন্দকার ও তাঁর ভাইয়েরা। তাঁরা জাল রেকর্ড দেখিয়ে দেওয়ানি মামলা (১০৩/৯০, ১৮৭/৯২) করে আদালত থেকে একতরফা রায় নিয়ে তাঁদের আত্মীয়র নামে দলিল রেজিস্ট্রি করে নেন। পরে সরকারপক্ষ দেওয়ানি আপিল (২৫৩/৯৩ ও ২৫৪/৯৩) দায়ের করে দুই তরফা সূত্রে রায় ও ডিক্রি পায়। ওই রায়ের আলোকেই জাল দলিল বাতিল করা হয়। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে জজবাড়ির লোকজন হাইকোর্টে আপিল (এফএ ৯৪/০৭ ও এফএ ৯৫/০৭) করেন। এরপর রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ আসে। এই যুগ্ম জেলা জজ আবুল হোসেন খন্দকারকে নিয়ে ‘জমিদারবাড়ি এখন জজবাড়ি’ শিরোনামে ২০১২ সালের ১১ মে কালের কণ্ঠে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এদিকে গত ১২ আগস্ট ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করে আসামিদের খালাস দেওয়ার অভিযোগে বিশেষ দায়রা জজ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক ফারুক আহাম্মদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অবসরে যাওয়ার আগে মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন চোরাচালান মামলায় অস্বাভাবিক গতিতে বিচারকাজ শেষ করে বহুসংখ্যক আসামিকে বেকসুর খালাস দেন ওই বিচারক। অভিযোগ আছে, এসব মামলার রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারিক কার্যক্রমের স্বাভাবিক নিয়মনীতি উপেক্ষা করা হয়। বেশ কিছুদিন যাবৎ পত্র-পত্রিকায় ওই বিচারকের বিভিন্ন মামলার রায়ের অস্বাভাবিকতা তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয়। গত ১৬ জুলাই ‘তিন মাদক চোরাচালান মামলা- অবসরে যাওয়ার আগে ১১ আসামিকে খালাস দিলেন বিচারক’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন দৈনিক কালের কণ্ঠে ছাপা হয়। অস্বাভাবিক দ্রুততায় এসব মামলার বিচারকাজ শেষ করা হয় বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পরদিন বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘খালাস পেয়ে যাচ্ছে ভয়ংকর আসামিরা’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রয়োজনীয় সাক্ষীদের আদালতে হাজির না করেই মামলার বিচারকাজ শেষ করা হয়। সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট আরেকটি দৈনিক পত্রিকায় ‘মামলা খালাসের রেকর্ড’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ওই আদালত নিয়ে। এতে বলা হয়, ১৮ কার্যদিবসে ২৪ মামলার আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্রে এসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর গত ৭ আগস্ট তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজে ঢাকার ওই আদালতে গিয়ে বেশ কয়েকটি নথি জব্দ করেন। সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে তিনি অস্বাভাবিকতা দেখতে পান। এরপর আইন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে এবং প্রতিবেদন পাঠাতে বলেন। তাঁর নির্দেশ আইন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছার পর আইন মন্ত্রণালয় দুদককে ব্যবস্থা নিতে বলে। দুদক সূত্রে জানা যায়, কমিশনের ১২ আগস্টের নিয়মিত বৈঠকে বিষয়টি তোলা হয়। একই দিন দুদকের উপপরিচালক যতন কুমার রায়কে প্রধান করে দুই সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্য হলেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। সাবেক বিচারক মোতাহার হোসেনের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নামে দুদক গত ২১ জানুয়ারি। তিনি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অবসরে যান তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। এই বিচারক বিদেশে অর্থপাচার মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে গত ১৭ নভেম্বর বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। এরপর তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, তিনি বিদেশে চলে গেছেন। এ প্রসঙ্গে দুদকের মহাপরিচালক জিয়াউদ্দিন আহামেদ (অনুসন্ধান ও তদন্ত) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিচারকদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত করতে গিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন না আমাদের কর্মকর্তারা। পত্রপত্রিকায় বিচারকদের দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হলে আমরা আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করি। আবার দুদকেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে, সেটা যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমরা দুর্নীতির ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। আরো যেসব বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, সেই বিচারকদের দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’ দুদকের উপপরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘তিন বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে। এর আগেও বিচারকদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হয়েছে। মাঝেমধ্যেই বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে দুদক।’ গত বছর ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হন সিনিয়র সহকারী জজ জাভেদ ইমাম। তিনি যশোরে কর্মরত থাকা অবস্থায় দুর্নীতির মাধ্যমে আসামিদের খালাস ও জামিন দিয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন বলে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় আইনজীবীরা। সাতক্ষীরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক এক বিচারকের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ওই বিচারকের অপসারণ দাবিতে স্থানীয় আইনজীবী সমিতি আদালত বর্জন করেছে। এরই মধ্যে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি তিন বিচারককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর প্রস্তাব অনুমোদন করেন সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভা। তাঁদের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আরেকজন বিনা অনুমতিতে ১১ মাস ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। যাঁদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে তাঁরা হলেন চট্টগ্রামের শ্রম আদালতের সাবেক বিচারক (জেলা জজ) ইশতিয়াক আহমেদ, যশোরের অতিরিক্ত জেলা জজ মিজানুর রহমান ও লালমনিরহাটের যুগ্ম জেলা জজ সালাউদ্দিন আকরাম। সূত্র মতে, শ্রম আদালতের বিচারক থাকাকালে ইশতিয়াক আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া বিচারক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পাশাপাশি বিচারক সালাউদ্দিন আকরাম বিনা অনুমতিতে ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ-সংবলিত সরকারি প্রস্তাবে অনুমোদন দেন ফুলকোর্ট। দুর্নীতির অভিযোগে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো দুই বিচারকের বিরুদ্ধেও দুদক মাঠে নামবে বলে জানা গেছে। গত বছর কুষ্টিয়ার দুই বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে আইনজীবী সমিতি আইনমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেয়। তাঁদের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধানে নামতে পারে দুদক। ২০০৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ওই বিচারপতির ছেলে ও মেয়ের জামাইয়ের বিরুদ্ধেও মামলা করে দুদক। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধান চালায় দুদক। পরে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাঁকে সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment