Thursday, October 16, 2014

নির্মাণযজ্ঞ শুরু পদ্মা সেতুর:কালের কন্ঠ

পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়। এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের যন্ত্রপাতি ও নির্মাণসামগ্রীর চালান মাওয়ায় পৌঁছাতে শুরু করেছে। রবিবার ভোরে তৃতীয় চালান নিয়ে দুটি বড় জাহাজ কক্সবাজারের কুতুবদিয়া মোহনায় গভীর সমুদ্রে নোঙর করেছে। চীন থেকে আসা এসব মালপত্র শিগগিরই মাওয়া ঘাটে পৌঁছাবে। এসব যন্ত্রপাতি আসার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে নভেম্বরে শুরু হবে মূল সেতুর নির্মা
ণকাজ। এতে চীন ও বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ কাজ করবে। সে জন্য বিদ্যমান মাওয়া লঞ্চঘাট সরিয়ে শিমুলিয়ায় স্থানান্তর করা হচ্ছে। পুনর্বাসন, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণসহ অনেক কাজই শেষ হয়েছে। গতি পেয়েছে সংযোগ সড়ক, তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও নদী শাসনের প্রাথমিক কাজেও। সরেজমিনে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূল সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে মাওয়া চৌরাস্তা বরাবর বর্তমান ঘাট এলাকা দিয়ে। এ জন্য মাওয়া ঘাট দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে কুমারভোগের শিমুলিয়া বাজারের কাছে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে ঘাট স্থানান্তরের জন্য সেনাবাহিনী দুই কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের কালের কণ্ঠকে জানান, মূল সেতু নির্মাণের উপকরণের দুটি চালান মাওয়ায় পৌঁছেছে। আর তৃতীয়টি কয়েক দিনের মধ্যে কুতুবদিয়া থেকে মাওয়া ঘাটে পৌঁছাবে। এই চালানে ড্রেজার, ভাসমান ক্রেন, টাগবোটসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি রয়েছে। পানির গভীরতা কম থাকায় এসব যন্ত্রবাহী দুটি বড় জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৪৫ নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙর করেছে। তৃতীয় এই চালানটি ২৯ সেপ্টেম্বর চীনের সাংহাই বন্দর থেকে রওনা হয় । চায়না মেজর ব্রিজের নিয়োগ করা লজিস্টিক ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিংয়ের এজেন্ট এসআই চৌধুরী অ্যান্ড কম্পানি লিমিটেডের (সিকো সিকো) নির্বাহী পরিচালক আলী আহমেদ (আলী) জানান,  চীন থেকে যেসব যন্ত্রপাতি এসেছে সেগুলো মাওয়ার কাছে কুমারভোগে পদ্মা সেতু কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে খালাস করা হয়েছে। চায়না মেজর ব্রিজের বাংলাদেশি কান্ট্রিপ্রধান রেম কালের কণ্ঠকে জানান, মূল সেতুর কাজে প্রায় সাড়ে তিন হাজার দেশি-বিদেশি লোকবল কাজ করবে। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০০ চীনা নাগরিক ও তিন হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ও কর্মকর্তা থাকবে। এরই মধ্যে ২০০-এরও বেশি চীনা কর্মকর্তা ও শ্রমিক সেতুর কাজে সম্পৃক্ত হয়েছে। সেতু নির্মাণের উপকরণের সংস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, লোহার যে প্লেট বা অ্যাঙ্গেল লাগবে, তা ভারত থেকে কেনার সম্ভাবনা রয়েছে। আর ইট, সিমেন্ট, পাথর, বালুসহ অন্যান্য সামগ্রী বাংলাদেশ থেকেই নেওয়া হবে। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সেতু নির্মাণের বিভিন্ন কাজ আগেই শুরু হয়েছে। আর মূল সেতু নির্মাণে চায়না মেজর ব্রিজ প্রয়োজনীয় উপকরণ মাওয়া ঘাটে নিয়ে আসছে। তিনি জানান, সেতু নির্মাণে অগ্রগতি দেখতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আজ বৃহস্পতিবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহ্ নূর জিলানী (পিএসসি) কালের কণ্ঠকে বলেন, মাওয়ায় ভাঙন ঠেকানো এবং এ অঞ্চলের বাড়িঘর রক্ষা করতে জরুরি আপৎকালীন প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ গত মে মাসে শেষ হয়েছে। তীর থেকে নদীর দিকে প্রায় ১৩০ মিটার পর্যন্ত স্তরে স্তরে বালুর বস্তা ফেলে নদীর তলদেশ সমান করে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর নদীর তলদেশে আধুনিক যন্ত্র দিয়ে জরিপ করে দেখা গেছে, গেল বর্ষায় এ বাঁধের কোনো ক্ষতি হয়নি। কাজের মান বজায় রাখতে সেনাবাহিনী এখানে বালুর মান নির্ণয়ের জন্য বসিয়েছে বিশেষ যন্ত্র।  ১৪ লাখ জিও ব্যাগ ভর্তি বালু নদীতে ফেলা হয়েছে। তা ছাড়া দোগাছি সার্ভিস এরিয়া-১-এ সেনাবাহিনী সিমেন্ট, বালু, রড, ইট, পাথরের মান নির্ণয়ের জন্য একটি আধুনিক পরীক্ষাগারও স্থাপন করেছে। মূলত সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড, ২০ বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন পদ্মা সেতুর সব ধরনের নিরাপত্তার কাজ করছে। আর ২০ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের কর্নেল সারোয়ারের নেতৃত্বে মাওয়া প্রান্তে প্রায় দুই কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ গত বছর শুরু হয়। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি এর কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (নদী শাসন) শারফুল ইসলাম বলেন, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড নদী শাসনের কাজের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। খুব শিগগির কার্যাদেশ দেওয়া হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুনর্বাসন প্রকল্প) মো. তোফাজ্জেল হোসেন জানান, প্রকল্পের জন্য মোট এক হাজার ১০০ হেক্টরেরও বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তের জশলদিয়া ও কুমারভোগ পুনর্বাসন প্রকল্পসহ দুটি অতিরিক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের জন্য ৩০ দশমিক শূন্য ৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এসব পুনর্বাসন কেন্দ্রে মোট ৯৯৮টি প্লট তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫০টি প্লট ক্ষতিগ্রস্ত ভূমির মালিকদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার জন্য নির্মিত হচ্ছে মাওয়া-জাজিরা সেনানিবাস। সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড সেনানিবাস নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এই ব্রিগেডের আওতায় দুই হাজার সেনা সদস্য কাজ করছেন। আপাতত পুনর্বাসন কেন্দ্রে থেকে কাজ করছেন তাঁরা।   পদ্মাপাড়ের রফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর বিশাল কাজ দেখে খুব ভালো লাগছে। আর কোনো বাধাই সেতু নির্মাণ আটকাতে পারবে না। সেতু প্রকল্পের অন্য প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচরেও কর্মযজ্ঞ শুরু হচ্ছে। জাজিরা-শিবচর অংশের প্রায় ১১ কিলোমিটারজুড়ে চলছে নির্মাণ মহাযজ্ঞ। জাজিরা অংশে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ যৌথভাবে করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ান এইচসিএম। এই সংযোগ সড়ক প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটি সেতু, ২০টি কালভার্ট, আটটি আন্ডারপাসও রয়েছে। এরই মধ্যে শিবচরের পাচ্চর, কাঁঠালবাড়ী, কাওড়াকান্দি ও দেওড়ায় চারটি স্টক ইয়ার্ড নির্মাণ করে বিপুল পরিমাণ মালামাল ও সরঞ্জাম আনা হয়েছে। সড়কটিতে মোট ৪১ লাখ ঘনমিটারের মধ্যে ১২ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালু ভরাট শেষ হয়েছে। এসব ইয়ার্ডে ভারতের পাকুর ও সিলেট থেকে এনে আড়াই লাখ ঘনমিটার পাথর মজুদ করা হয়েছে। অন্যান্য সরঞ্জাম ছাড়াও মাটির পরীক্ষা ও গুণমান ঠিক করতে জার্মানি থেকে আনা হয়েছে সেন্ট পাইলিং রিগ নামের অত্যাধুনিক যন্ত্র। সব মিলিয়ে সংযোগ সড়কের কাজ ২১ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ৩০ জন দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞ প্রকৌশলীসহ প্রতিদিন প্রায় ৭০০ জনবল বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করছেন। এ ছাড়া মূল সেতুর জন্য জাজিরার নাওডোবায় নির্মাণ করা হচ্ছে সার্ভিস এরিয়া-২। আব্দুল মোনেম লিমিটেডের প্রশাসন বিভাগের এজিএম খন্দকার আহমেদ আলী জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হবে। সংযোগ সড়ক প্রকল্পটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়োগ করা প্রকৌশলী পরামর্শক মো. জামিলুল হক জানান, সংযোগ সড়কের অবকাঠামোগত কাজের ১৯ শতাংশের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সার্ভিস এরিয়া-২-এর নির্মাণকাজও ৪ শতাংশ হয়েছে। নির্ধারিত সময়েই বাকি কাজ শেষ হবে।  

No comments:

Post a Comment