Tuesday, October 28, 2014

শহরগুলো নারীদের জন্য নিরাপদ নয়:প্রথম অালো

নিজেদের চলাচলের জন্য শহরগুলোকে নিরাপদ মনে করছেন না নারীরা। শহরের ৯৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানিকে সহিংসতা মনে করেন। এ ধরনের হয়রানির শিকার ৮১ শতাংশ নারী পুলিশের সহায়তা নিতেও ভয় পান। তাঁরা মনে করেন, পুলিশের সাহায্য চাইলে সমস্যা বাড়ে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ‘নিরাপদ নগর কর্মসূচির ভিত্তিমূলক জরিপ’ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) দুজন গবেষক এ জর
িপে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জরিপটি আজ প্রকাশ করা হচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, নারীরা গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহনে, রাস্তায়, বাজারে ও বিপণিবিতানে সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন। খুব সকালে, দিনের মধ্যভাগে ও সন্ধ্যায় যৌন হয়রানির ঘটনা বেশি ঘটে। সুবিধাবঞ্চিত বা দরিদ্র পরিবারের নারী ও মেয়েদের এ ক্ষেত্রে বিপদ অনেক বেশি। প্রথমত, তাঁরা ঘটনার শিকার হন; দ্বিতীয়ত, ঘটনার জন্য সমাজ তাঁদেরই দায়ী করে। গবেষকেরা বলছেন, প্রকাশ্য স্থান বা জনসমক্ষে (পাবলিক প্লেস) নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে সমাজ মেনে নিয়েছে এবং মনে করা হয় যে নারীর অবাধ চলাফেরা ও তাঁর পোশাকের কারণে তাঁরা যৌন হয়রানির শিকার হন। তবে যৌন হয়রানির সব ঘটনা জানা যায় না। অনেক নারী বা তাঁর পরিবার ঘটনার ব্যাপারে অভিযোগ জানাতে চান না। অনেক সময় তাঁরা ভয় পান অথবা ফল পাওয়া যাবে না বলে অভিযোগ করাকে অর্থহীন মনে করেন। গবেষকেরা বলছেন, যৌন হয়রানি হচ্ছে অজানা বা অপ্রত্যাশিত যৌন আচরণ। এর মধ্যে পড়ে স্পর্শ, ধাক্কা, শারীরিকভাবে এগিয়ে আসা, যৌন চাহিদা প্রকাশ, যৌনতার কৌতুক বলা, আগ্রাসী দৃষ্টিতে তাকানো, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা, কুপ্রস্তাব, অশ্লীল ছবি দেখানো বা রচনা পড়তে দেওয়া। নারীর চরিত্র হনন করে, তাঁর বদনাম ছড়ায়, তাঁর পেশা বা কাজকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে—এমন কথাবার্তা বা শারীরিক কাজ যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ধর্ষণ। হয়রানি সর্বত্র: জরিপে উত্তর দেওয়া নারীরা বলেছেন, সাধারণ মানুষ যায় এমন প্রায় সব জায়গাতেই তাঁরা যৌন হয়রানির শিকার হন। ৮৫ শতাংশ নারী মর্যাদাহানিকর উক্তির শিকার হয়েছেন, ৪৬ শতাংশ নারী যৌনতাপূর্ণ অশ্লীল ভাষার মুখোমুখি হয়েছেন, ৪৮ শতাংশ নারীর বাসের চালক বা ভাড়া আদায়কারীর মুখে অবমাননাকর ভাষা শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। উত্তরদাতাদের ৮৮ শতাংশ বলেছেন, বাজার বা বিপণিবিতানে সাধারণ মানুষও নারীদের উদ্দেশে অশ্লীল কথা বলেন। ৬৯ শতাংশ বলেছেন, দোকানের কর্মচারী বা বিক্রেতারা তাঁদের দেখে অশ্লীল মন্তব্য করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, রাস্তায় নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন। ৮৫ শতাংশ নারী ও ৭৭ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, নারী হয়রানির শিকার বেশি হন রাস্তায় বা ফুটপাতে। এর পরে বাস টার্মিনাল বা রেলস্টেশনে। বাজার ও বিপণিবিতানের কথা বলেছেন অর্ধেক উত্তরদাতা এবং ৪০ শতাংশ বলেছেন পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্রে হয়রানি হওয়ার কথা। উত্তরদাতারা বলেছেন, দিনের যেকোনো সময়ের চেয়ে খুব সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় হয়রানির ঘটনা বেশি ঘটে। পুলিশের সহায়তা চান না: পুলিশের নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে জনসমক্ষে যৌন হয়রানির শিকার হয়েও নারীরা পুলিশের কাছে যান না। ৮১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা পুলিশের সহায়তা চান না। এঁদের ৯৫ শতাংশ মনে করেন, পুলিশকে ঘটনা জানালে সমস্যা বাড়ে। পুলিশ অপরাধীর পরিবর্তে ঘটনার শিকার নারীকেই দোষ দেয় (৬৫ শতাংশ); পুলিশ বিষয়টি হালকাভাবে নেয় এবং অপরাধীকে আইনের আওতায় আনে না (৫৭ শতাংশ); পুলিশ ঘটনার তথ্য হয়তো লিপিবদ্ধ করে কিন্তু আর এগোয় না (৩৭ শতাংশ); অভিযোগ করে কোনো ফল হবে না (৫৩ শতাংশ)। এঁদের ২৮ শতাংশ থানায় বা পুলিশের কাছে যেতে ভয় পান। আর ১২ শতাংশ মনে করেন, পুলিশের কাছে গেলে হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে হয়রানির ভয়ে নারীরা পুলিশের কাছে যেতে চান না বলে জরিপে যে তথ্য এসেছে, তার সঙ্গে একমত নন পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দেশে প্রতিবছর যত মামলা হয়, তার একটি বড় অংশ নারী নির্যাতনের মামলা। এসব মামলার বাদীও নারী। পুলিশ তাঁদের প্রতি যত্নবান না হলে কী করে এসব মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। আবার এটাও সত্য যে কেউ কেউ নিজের কাজের ব্যাপারে দায়িত্বশীল না-ও হতে পারেন। তার সংখ্যাও যে খুব বেশি, সেটা নয়। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও আছে। মামলা করেও হতাশ ভুক্তভোগী পরিবার জরিপে অংশ নেওয়া নারীরা বলেছেন, যৌন হয়রানি বা সহিংসতা এড়ানোর জন্য তাঁরা কিছু কৌশল অবলম্বন করেন। যেমন উত্তরদাতাদের ৬২ শতাংশ বলেন, তাঁরা রাতে ঘরের বাইরে যেতে চান না। একা ঘরের বাইরে যেতে চান না (৬০ শতাংশ), নির্দিষ্ট এলাকা এড়িয়ে চলেন (৪৭ শতাংশ), জনবহুল স্থান ও নির্জন স্থান এড়িয়ে চলেন (যথাক্রমে ২৩ ও ২৬ শতাংশ)। এঁদের মধ্যে ১৩ শতাংশ নারী গণপরিবহন ব্যবহার করা বন্ধ করেছেন, ২১ শতাংশ উত্তরদাতা রঙিন পোশাক পরা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে ৩ শতাংশ নারী বলেছেন, আত্মরক্ষায় তাঁরা অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখেন। এক-চতুর্থাংশ নারী বলেছেন, তাঁরা কোনো কৌশল অবলম্বন করেন না। কারণ, কোনো কৌশলই উপকারে আসবে না। তাঁরা এ হয়রানি মেনে নিয়ে, সহ্য করে জীবন যাপন করছেন। গবেষকেরা জানতে চেয়েছিলেন, যৌন হয়রানি নারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কি না। ৯০ শতাংশ নারী ও ৯২ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, যৌন হয়রানি নারীর জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং নারীর ভালো থাকার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ জরিপের সঙ্গে দ্বিমত নেই সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজের। তবে তিনি মনে করেন, এর মানে এটা নয় যে নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জনসংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমন গণমাধ্যমে প্রচারও বেড়েছে। আগে নির্যাতনের শিকার নারী মুখ খুলতেন না, এখন মুখ খুলছেন। ফলে কোনো ঘটনাই গোপন থাকছে না। নির্যাতনের শিকার বেশির ভাগ নারী পুলিশের সহায়তা নিতে চান না, এ কথাও মানেন মেহের আফরোজ। কারণ, নির্যাতনের শিকার নারীকে কথাগুলো বলতে হয় পুরুষ পুলিশের কাছে। ফলে অনেকে অস্বস্তিবোধ করেন। তাই প্রতিটি থানাকে নারীবান্ধব করার জন্য পুলিশ প্রশাসনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার প্রস্তাব করেন তিনি। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাগুজে কমিটি সমীক্ষা পদ্ধতি: জরিপে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ৪০০ নারী ও কিশোরী (১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী) এবং ৪০০ পুরুষের (এর মধ্যে ২০০-এর বয়স ১৮ বছরের কম) সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। উত্তরদাতাদের ৪৮০ জন দরিদ্র শ্রেণির, ৪৮০ জন মধ্যম আয়ের এবং ২৪০ জন উচ্চ আয়ের। এ ছাড়া পুলিশ, স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ, নগর পরিকল্পনাকারী, যানবাহন কর্তৃপক্ষ, বাসচালক এবং বাসের ভাড়া আদায়কারীর (মোট ৭১ জনের) সাক্ষাৎকার নেন গবেষকেরা। বিভিন্ন শহরে কমিউনিটি নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও নারীদের নিয়ে আয়োজিত ১৪টি দলীয় সভার তথ্য ও মতামত এ জরিপে ব্যবহার করা হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ করা হয় এ বছরের মধ্য মে থেকে মধ্য জুনের মধ্যে। করণীয়: গবেষকেরা বলছেন, যৌন হয়রানি বা সহিংসতার পেছনে কতকগুলো কারণ আছে। যেমন যৌন হয়রানি বিষয়ে কোনো আইন না থাকা, ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করার সংস্কৃতি, নারীর ন্যায়বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক ও সামাজিক বাধা, জটিলতা ও দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ঘাটতি। গবেষকেরা পরিস্থিতি বদলাতে বিদ্যমান আইন সংস্কার বা যৌন হয়রানি বন্ধে নতুন আইন প্রণয়ন, ঘটনার শিকার নারীকে যথাযথ সহায়তার ব্যবস্থা, দায়ী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা এবং পাঠ্যসূচিতে জেন্ডার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, যৌন হয়রানি বন্ধে পুলিশে পৃথক বিভাগ খোলা যেতে পারে। যৌন হয়রানি এড়াতে নারীর কৌশল রাতে ঘরের বাইরে যেতে চান না ৬২% একা ঘরের বাইরে যেতে চান না ৬০% নির্দিষ্ট এলাকা এড়িয়ে চলেন ৪৭% জনবহুল ও নির্জন স্থান এড়িয়ে চলেন ২৩% ও ২৬% গণপরিবহন ব্যবহার করা বন্ধ করেছেন ১৩% রঙিন পোশাক পরা ছেড়ে দিয়েছেন ২১% আত্মরক্ষায় অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখেন ৩% সূত্র: অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ

No comments:

Post a Comment