Thursday, October 30, 2014

নিজামীর ফাঁসির আদেশ:যুগান্তর

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আলবদর বাহিনীর প্রধান জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বুধবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে এই বদর নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে। এই আটটির মধ্যে ২,
৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগের দায়ে নিজামীকে প্রতিটির জন্য আলাদাভাবে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়। এই চার অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, নিরীহ মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা রয়েছে। নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে এই রায়ে। এছাড়া প্রমাণিত হওয়া আটটির মধ্যে বাকি ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগের দায়ে জামায়াত আমীর নিজামীকে প্রতিটির জন্য আলাদাভাবে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই চার অভিযোগে নিরীহ মানুষকে আটক, নির্যাতন, হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র এবং তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার কথা বলা হয়েছে। নিজামীর বিরুদ্ধে আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে বাকি আটটি প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল কয়েকটি দিক বিবেচনায় এনে নিজামীকে এই সাজা প্রদান করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেÑ আলবদর বাহিনীতে নিজামীর অবস্থান, প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ। দুষ্কৃতকারী হিসেবে তার ভূমিকা এবং অধীনস্থদের ফৌজদারি অপরাধ করার ক্ষেত্রে সুপিরিয়র হিসেবে তার ভূমিকা। এছাড়া অপরাধের হিংস তা ও নৃশংসতার প্রকৃতি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। রায়ে বলা হয়েছে, চারটি মৃত্যুদণ্ডের আদেশের মধ্যে যে কোনো একটি যখন কার্যকর হয়ে যাবে, তখন অন্য তিনটি মৃত্যুদণ্ড ও চারটি যাবজ্জীবন দণ্ডের আদেশও কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে। জামায়াতের বর্তমান আমীর নিজামী চার দশক আগে ছিলেন জামায়াতেরই ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান। এই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন তিনি। এছাড়া স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন- পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মামলার রায়ে উঠে এসেছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, প্রমাণিত হওয়া ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে শত শত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ, অসংখ্য বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীকে হত্যা করার কথা বলা হয়েছে। এসব অপরাধের মধ্য দিয়ে ’৭১ সালে গণহারে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে। নিহত বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, নিরস্ত্র মানুষের স্বজন ও জাতি দশকের পর দশক অকথ্য যন্ত্রণা ও ব্যথা বহন করে বেড়াবে এবং আইন সেখানে নিষ্ক্রিয় থাকবে তা হতে পারে না। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য দুষ্কৃতকারীরা যে অপরাধ করেছে তার জন্য তাদের মূল্য দিতে হবে। অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় মৃত্যুই হতে পারে এই বীভৎস অপরাধের সমতুল্য সাজা। বৃহৎ পরিসরে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না দেয়া হলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হবে। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, এ রায় ন্যায়ভ্রষ্ট। আপিলে অবশ্যই এ রায় টিকবে না। আমরা অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করব। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. আলী বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১২ সালের ২৮ মে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উসকানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি অভিযোগে নিজামীর বিচার শুরু হয়। বিচার শেষ হয় গত বছরের ১৩ নভেম্বর। রায় ঘোষণা তিন দফায় অপেক্ষমাণ থাকার পর বুধবার তা ঘোষণা করা হয়। এর আগে মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার এই দিন ধার্য করা হয়। পাশাপাশি নিজামীকে বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির করারও নির্দেশ দেয়া হয়। এই নির্দেশ মোতাবেক বুধবার সকাল ৯টা ১৯ মিনিটে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে নিজামীকে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যানে পুরনো হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা এই জামায়াত নেতাকে রাখা হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়। ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে নেয়ার আগে প্রায় দেড় ঘণ্টা তাকে সেখানেই রাখা হয়। সাদা পাঞ্জাবির ওপর কফি রংয়ের কোটি পরা জামায়াত আমীরের মাথায় এ সময় ছিল একটি জিন্নাহ টুপি। কখনও গালে হাত দিয়ে, কখনও আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে তাকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। তাকে কাঠগড়ায় তোলা হয় বেলা ১১টায়। ওই সময় তাকে বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। এর কিছু সময় পর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক এজলাসে আসেন। আসন গ্রহণের পর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম সূচনা বক্তব্যে বলেন, ‘রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে রায়ের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। আমরাও অপেক্ষায় ছিলামÑ কখন রায় দিতে পারব। দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে বিভিন্ন মহল ও গণমাধ্যমে নানা কথা উঠেছে। বিচারক হিসেবে এসব কথার জবাব দেয়ার সুযোগ আমাদের নেই। জবাব দেয়া উচিতও হবে না। আদালত রাস্তায় গিয়ে কথা বলতে পারেন না। আমরা বোবার মতো থাকি। মন্তব্য করার ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত, আমরা (আদালত) কোনো জবাব দিতে পারব না। চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আমরা নিজের বিবেক, আইন ও সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হই। আমাদের ওপর কোনো নির্দেশ নেই। আমরা আপসও করি না। আপস করি আইন ও সংবিধানের সঙ্গে।’ এরপর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান জানান, মোট রায় ২০৪ পৃষ্ঠার। এর কিছু অংশ পড়ে শোনানো হবে। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে প্রারম্ভিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন তার অংশের রায় পড়া শুরু করেন বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে। তারপর মূল রায়ের অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। রায় পাঠ শেষ হয় দুপুর ১২টা ২৪ মিনিটে। রায় ঘোষণার পুরো সময়ই এজলাসের কাঠগড়ায় নির্বাক ছিলেন নিজামী। রায় প্রদান শেষেও কোনো কথা বলেনি এই জামায়াত নেতা। বিচার শুরু : ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর থেকে কারান্তরীণ রয়েছেন তিনি। ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর জামায়াতের আমীরের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। ২৮ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগ আমলে নেন। এরপর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ২৮ মে জামায়াত আমীরের বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খানের জবানবন্দি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গত বছর ২৬ আগস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট ২৬ জন। এর মধ্যে একজন সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করা হয়েছে। আর নিজামীর পক্ষে তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। বাকি তিনজন হলেন- অ্যাডভোকেট কেএ হামিদুর রহমান, মো. শামসুল আলম ও আবদুস সালাম মুকুল। সাক্ষ্য ও জেরা শেষে গত বছরের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রথম দফা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। ১৩ নভেম্বর এ মামলার বিচারকার্য সমাপ্ত করে ট্রাইব্যুনাল রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। বিচারে কেন বিলম্ব : ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম। এ রায়টি অপেক্ষমাণও ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। গত বছরের ১৩ নভেম্বর প্রথম দফায় এ মামলার কার্যক্রম শেষে যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে বলে জানান ট্রাইব্যুনাল। সেই থেকে এই রায়ের জন্য অপেক্ষার শুরু। রায় ঘোষণার আগেই ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর। এই বিচারকের অবসরের ৫৩ দিন পর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এরপর নতুন করে মামলার উভয়পক্ষকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ দেন ট্রাইব্যুনাল। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২৪ মার্চ দ্বিতীয় দফায় রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। অপেক্ষমাণ রায়টি ২৪ জুন ঘোষণার জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু ওই দিনও এ রায় ঘোষণা সম্ভব হয়নি। ওই দিন কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে হাজির না করে তিনি অসুস্থ বলে ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন পাঠায়। আসামির অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা যুক্তিসঙ্গত মনে না করায় ওই দিন (২৪ জুন) ট্রাইব্যুনাল তৃতীয় দফায় মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন? এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীর স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে ৩ জুলাই একটি প্রতিবেদন দেয়, যাতে নিজামী ‘সুস্থ’ আছেন বলে জানানো হয়। কিন্তু প্রতিবেদন পাওয়ারও প্রায় চার মাস পর এই অপেক্ষমাণ রাখা রায়টি বুধবার ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনাল-১ ও ট্রাইব্যুনাল-২-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যতগুলো মামলা বিচারাধীন বা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো নিজামীর মামলাটি। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে নিজামীকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে প্রথম আসামি ও দ্বিতীয় মামলার আসামি করা হয় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। এদের দু’জনের রায় ইতিমধ্যে ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে সাঈদীর মামলার আপিলের রায়ও ঘোষণা হয়েছে। সাকা চৌধুরীর মামলা আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। এছাড়া নিজামীর মামলার পরে দায়েরকৃত অনেক মামলাও নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এটি হবে ট্রাইব্যুনালের দশম রায়। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন, নিজামীর অসুস্থতা ছাড়াও এই মামলার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার আরও কারণ আছে? এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণই চলেছে প্রায় দেড় বছর? এছাড়া নিজামী ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি হওয়ায় তাকে সপ্তাহে দুই দিন চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হতো? এজন্যও এই মামলার কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হয়? গত ৩০ জানুয়ারি ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে নিজামীসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। বর্তমানে এই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে নিজামীর আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।  

No comments:

Post a Comment