দেশে ১৯৭৩ সালে সড়ক ছিল মাত্র চার হাজার কিলোমিটার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৫৮১ কিলোমিটার। এসব সড়কে প্রতিদিন গড়ে ১০টি দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে বেসরকারি হিসাবে দেশে দুর্ঘটনা ঘটে বছরে ১৫ হাজারের মতো। এসব দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবেই বছরে পাঁচ হাজারের বেশি প্রাণহানি ঘটে। বহু মানুষ পঙ্গু হন। অনেক সময় গাড়ির চালক হেলপাররাও নিহত হন। কিন্তু পরিবহন মালিকরা বরাবরই থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুর্ঘটনার পর কোনো মালিকের
সাজা হয়েছে এমন নজির নেই বাংলাদেশে। দুর্ঘটনার পেছনে গাড়ির মালিকের ভূমিকাও কম দায়ী নয়। যেমন তাঁরা ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ খাটিয়ে ফিটনেসহীন গাড়ি রাস্তায় নামান, চালকদের নিয়োগপত্র দেন না, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে চালকদের বেশি খাটান, খরচ কমাতে তাঁরা লাইসেন্সহীন অদক্ষ চালকের হাতে তুলে দেন গাড়ির চাবি। পাশাপাশি দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা, দক্ষ চালক তৈরি না করা এবং চাঁদা নিয়ে অবৈধ গাড়ি চলাচলে পুলিশের সহযোগিতা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো ইত্যাদি। এই পরিস্থিতিতে ২১ বছর ধরে দাবি তোলা হলেও সরকার এখনো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করতে পারেনি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে দেশে ২০ লাখ গাড়ির নিবন্ধন রয়েছে। এর মধ্যে তিন লাখেরই ফিটনেস নেই। রাজধানী থেকে চলাচলকারী ফিটনেসহীন গাড়ি আছে প্রায় ৯০ হাজার। সর্বশেষ গত সোমবার দুপুরে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে সংঘটিত দুর্ঘটনায় ৩৪ জনের প্রাণহানির পেছনে গাড়ির ফিটনেসহীনতাও একটি বড় কারণ বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে। ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী কেয়া পরিবহন ও নাটোর থেকে গুরুদাসপুরমুখী অথৈ পরিবহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। অথৈ পরিবহনের চালক আলম মণ্ডল দুর্ঘটনায় মারা যান। এই গাড়ির কোনো কাগজপত্রই ছিল না। এভাবে দেশের ৩৬১টি রুটে বাধাহীনভাবে চলছে ফিটনেসহীন গাড়িগুলো। খোদ রাজধানীতেও একই অবস্থা। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, বাস মালিকরা ফিটনেসহীন গাড়ি চালাচ্ছেন পুলিশকে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে। কয়েক দিন আগে রাজধানীর বাড্ডায় সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো-জ-১১-২২৩৫) উঠে দেখা যায়, বিকট শব্দ হচ্ছে গাড়িটিতে। গাড়িটি চালান ভাগাভাগি করে মো. বাবু ও বিল্লাল মিয়া। সহকারী সাইফুল বলেন, ‘গাড়ির কাগজপত্র আমাদের কাছে নেই।’ জানা গেল, সদরঘাট-টঙ্গী রুটের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ গাড়ির চালককে আটকিয়ে চাঁদা নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। এ অবস্থা চলছে বিভিন্ন রুটে। ফিটনেসহীন গাড়ি ছাড়াও রাস্তায় প্রাণ কেড়ে নিচ্ছেন লাইসেন্সহীন চালকরাও। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৬ লাখ বা ৬১ শতাংশ চালকেরই বৈধ লাইসেন্স নেই। দায়দায়িত্ব এড়াতে এই অবৈধ চালকদের নিয়োগপত্র দেন না মালিকরা। এতে দুটি লাভ। প্রথমত, নিয়োগপত্র না থাকায় আইন অনুসারে শ্রমঘণ্টা অনুযায়ী মজুরি দিতে হয় না। দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনার দায়ও এড়ানো যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ট্রাকচালক আমজাদ আলী কালের কণ্ঠকে এ বিষয়ে বলেন, টানা ১৫ দিন গাড়ি চালাতে হয়। আমার কোনো নিয়োগপত্র নেই। প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৪ এ নিয়োগপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করার বিধান রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী বলেন, দেশে ট্রাকচালকের অভাব রয়েছে। দক্ষ চালকরা মধ্যপ্রাচ্যে বেশি বেতনে চাকরি নিয়ে চলে যান। ১৯৯২ সালে চালকদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছিল। পরে ধারাবাহিকতা ঠিক থাকেনি। আমাদের দেশে নির্ঘুম অবস্থায়ও ট্রাক চালাতে হয় চালকদের। যাত্রীবাহী বাসে যাত্রীরা গাড়ি জোরে চালাতে বললে চালকরা কী করবেন? ২১ বছর ধরে সরকারি স্বীকৃতি নেই : দেশে ১৯৭৩ সালে সড়ক ছিল চার হাজার কিলোমিটার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার কিলোমিটারের বেশি। গাড়ি বেড়ে হয়েছে ২০ লাখ; কিন্তু বিস্তৃত এই খাতের জন্য ৭৫ বছরের পুরনো আইনই বহাল। চালকদের নিয়োগপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করা এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকের শাস্তির বিধান রেখে ২০১২ সালে একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হয়। কিন্তু পরিবহন মালিকদের চাপে এই খসড়া পড়ে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে। দেশে প্রতিবছর গড়ে ১৫ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে মামলা হচ্ছে গড়ে চার হাজারটি। বেশির ভাগ দুর্ঘটনার তথ্যই হারিয়ে যাচ্ছে মামলা না করায়। আবার যেসব মামলা হচ্ছে সেগুলোর তদন্ত আটকে যাচ্ছে পুলিশের গাফিলতিতে। আসামিদের সঙ্গে রফা হয়ে যাওয়ায় এগোয় না তদন্ত। আইনে ঘাতক চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখার দাবি ৩০ বছর ধরে তোলা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা মামলার ফৌজদারি আইনে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তার ওপর এটি জামিনযোগ্য অপরাধও। মোটরযান অধ্যাদেশে সর্বোচ্চ চার মাস কারাদণ্ড ও ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ অবস্থায় দায়ী চালকের সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করা হয়; কিন্তু এই শাস্তি কমানোর জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছেন পরিবহন খাতের নেতারা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রস্তাবিত আইনটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। যুগোপযোগী আইন করার ব্যর্থতাই শুধু নয়, এখন পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা দিবসও ঠিক করতে পারেনি সরকার। সড়ক দুর্ঘটনায় নিজের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের প্রাণহানির পর ২১ বছর ধরে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। ওই দুর্ঘটনার স্মৃতি তাঁকে শোকে স্তব্ধ করে দেয়। দেশে দুর্ঘটনা ঘটলে তাই বিচলিত হয়ে ওঠেন তিনি। আন্দোলনে তাঁর সঙ্গে যোগ হয়েছেন আরো অনেকে। তার পরও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনে সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। ২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সংঘটিত ওই দুর্ঘটনার দিনটিকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণার বিষয়ে একবার সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিল সরকার। পরে তা আর ঘোষণা করা হয়নি। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা জনমত যাচাই করেছিলাম। তাতে মিরসরাইয়ে দুর্ঘটনার দিনটিকে জাতীয় দিবস করার পক্ষে মত আসে। পরে এ ব্যাপারে মামলা হলে সে উদ্যোগ থেমে যায়।’ নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘‘২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালন করার দাবি ২১ বছর ধরে জানিয়ে আসছি; কিন্তু কোনো ফল হয়নি।’’ ২০২০ সালের মধ্যে দুর্ঘটনার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনার সরকারি পরিকল্পনাও ঝুলে আছে। স্বরাষ্ট্র, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বিষয়ে কোনো সমন্বয় নেই। মহাসড়কে নছিমন-করিমন-ভটভটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু টোল প্লাজায় ‘জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদের ১৯তম সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে’ জানিয়ে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের টানানো ব্যানার দেখা গেছে। তবে ওই পর্যন্তই। মহাসড়কে নছিমন-করিমন চলছে রমরমিয়ে। ভৈরবের স্থানীয় বাসচালক মো. জয়নাল আবেদীন কালের কণ্ঠকে বলেন, নছিমন চলছে পুলিশকে চাঁদা দিয়ে। সড়ক পরিবহনসচিব এম এ এন ছিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ফিটনেসহীন গাড়ি ধরতে জেলা প্রশাসকদের বলেছি। বিআরটিএর জনবল না থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে এত সব গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো সম্ভব হবে না। দুর্ঘটনার জন্য মালিকদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কারণ ফিটনেসহীন গাড়ি চালানোর চাবি তো দেন মালিকরাই।’ দুর্ঘটনা বাড়ছে : পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে প্রতিদিন ১০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনার একেকটিতে ৫ থেকে ৪৪ জনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ গত সোমবার হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে ৩৪টি প্রাণ নিভে যায়। মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর এখন কেবলই স্মৃতি। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকা এলাকায় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তাঁরা। এর আগে ২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ স্কুলছাত্রের প্রাণহানি ঘটেছিল। ওই দিন খেলা শেষে দুপুর দেড়টার দিকে মিরসরাই স্টেডিয়াম থেকে ফেরার পথে ছাত্রদের বহনকারী ট্রাকটি রাস্তার পাশে খাদে পড়ে উল্টে গেলে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। এ জন্য দেশে তিন দিনের শোক পালন করা হয়। সরকারি গাড়িও কেড়ে নিচ্ছে যাত্রী বা পথচারীর প্রাণ। গত ৯ অক্টোবর খুলনার খালিশপুরে বিআরটিসি বাস ও ইজিবাইকের সংঘর্ষে ইজিবাইকের চার যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। ওই দিন বিকেলে খুলনা-যশোর মহাসড়কের খালিশপুর বিজিবি ক্যাম্পের সামনে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীতে বিআরটিসি বাস-ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার ত্রিমুখী সংঘর্ষে এক ব্যক্তির প্রাণ যায়। বিআরটিসির বিভিন্ন ডিপোতে এখন চার শতাধিক বাস চলাচলের অনুপযোগী।
No comments:
Post a Comment