েন। সে সময় তিনি টাঙ্গাইল করটিয়া স্কুলের ছাত্র ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ম্যাট্রিক (এসএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশনে বয়স কমিয়ে ১৪ বছরের কোটায় রাখা হয়। তাই তাঁর বয়স কাগজপত্রে ১৯৭১ সালে ১৩-এর কম হয়ে যায়। তিনি বলেন, এখন নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থাকতে পারবেন না। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বছর ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে যুদ্ধ শেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ১৩ বছরের বালক লালু। সে সময় লালুর সঙ্গে তাঁর সমবয়সী আরো শত শত কিশোর-বালক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই ১৩ বছরের বালক লালু এখন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী সেই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লালু ও তাঁর বয়সী সবাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন! উল্লেখ্য, গত সোমবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ২৫তম সভায় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে যাঁদের বয়স কমপক্ষে ১৫ বছর ছিল তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীর কমপক্ষে ১৭ হাজার মানুষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই বয়স ছিল তখন ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। কিন্তু যারা পড়াশোনা করছিল তাদের বয়স স্কুল থেকে কমিয়ে দেওয়া হয়। এখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দেওয়া বয়সই মাপকাঠি। তা ছাড়া যাঁরা এখন আর চাকরি করেন না তাঁরা সরকারি জন্ম সনদ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে দাখিল করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী নভেম্বর মাস থেকে গত ১২ বছর যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন তাঁদেরও তৃণমূল পর্যায়ে যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে হাজির হতে হবে। নতুন আবেদনেও দেখাতে হবে ১৯৭১ সালে তাঁদের বয়স ছিল কমপক্ষে ১৫ বছর। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের কারণে সরকারি চাকরিতে কর্মরত কয়েক শ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এখন যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত আছেন তাঁদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়বেন। অথচ মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের দায়ের করা কয়েকটি রিট আবেদনেও কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। তাঁদের অবদানের কথাও হাইকোর্টের রায়ে বারবার উঠে আসে। নতুন করে সংজ্ঞা নির্ধারণে উচ্চ আদালতের ওই রায়কেও অবজ্ঞা করা হবে বলে মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও একই ধরনের রায় দেন পরবর্তী সময়ে। ৪৩ বছর পর কেন : মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, পুলিশ, বিজিবি বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থায় যোগদানের সময় বয়স নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সময় তো কোনো বয়সের নির্ধারণ করা ছিল না। তাহলে স্বাধীনতার এত বছর পর কেন বয়স নির্ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ঠিক করা হচ্ছে? জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন রাজিব বলেন, তাঁর বয়সও মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৬ বা এর চেয়ে একটু বেশি ছিল। কিন্তু তৎকালীন ম্যাট্রিক পরীক্ষার কারণে শিক্ষকরা তাঁর বয়স কমিয়ে ১৪ বছর করে দিয়েছিলেন। তিনি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তো বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশরক্ষার চেতনা নিয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় তালিকা, মুক্তিবার্তায় আমাদের নাম আছে। আমাদের সনদ ও গেজেটে নাম আছে। তাহলে কি আমরা বাদ যাব তালিকা থেকে? এটা হতে পারে না।’ আগেই বয়স নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু : নতুন করে সংজ্ঞা নির্ধারণের আগেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধার বয়স ১৫ বছর না হলে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া শুরু করেছে। এমনকি ইতিপূর্বে দেওয়া সনদও বাতিল করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অলিখিতভাবে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লালুকে আদর্শ ধরে এত দিন মন্ত্রণালয় ১৩ বছর বয়সীদের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করে যাচাই-বাছাইয়ের পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার আলোকেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এমন মানদণ্ডকে বয়সের পরিমাপ হিসাবে নিয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশে দেখা গেছে, তারা বাগেরহাট সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারী জগবন্ধু বিশ্বাসের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে দিয়েছে। আদেশে বলা হয়েছে, জগবন্ধুর বয়স প্রত্যাশিত ১৩ বছর না হওয়ায় তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যায়ন করা গেল না। একই সঙ্গে তাঁকে দেওয়া সাময়িক সনদও বাতিল করে দেওয়া হয়। এমন আরো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। উচ্চ আদালতের রায় : ১৯৭২ সালে নিয়োগ দেওয়া মুজিবনগর কর্মচারীদের ছাঁটাই করে চারদলীয় জোট সরকার। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের আবার নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সুপারিশ করে। কিন্তু সরকার এতে গড়িমসি করতে থাকে। পরে ১৯৯৭ সালে ছয়জন কর্মচারী যাঁদের বয়স ১৯৭১ সালে আট থেকে ১০ বছর ছিল, তাঁরা নিয়োগ পাওয়ার জন্য হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন। বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি হাসান আমিন ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই রায় দেন। রায়ে বলা হয়, মুজিবনগর কর্মচারীরা তরুণ বয়সী ছিলেন। তবে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারকে তথ্য সরবরাহ করেন। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ, অস্ত্র সরবরাহ ও বহন, খবর সরবরাহ, অস্ত্র সংরক্ষণ ও পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের অবুঝ মনে করায় অনেক কিছু এড়িয়ে যেত। তাই তাঁরা ঠিকমতো মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। আদালত বারবার উল্লেখ করেন, মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য অবদান রাখায় তাঁদের মুজিবনগরের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের বয়স নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। যাঁরা রিট আবেদন করেছিলেন তাঁরা হলেন মো. আবদুল কুদ্দুস হাওলাদার, মো. সালিম মল্লিক, আবু তালেব মিয়া, আবুল বাশার হাওলাদার, সলিম হাওলাদার ও আবদুর রহিম। এর আগেও মুজিবনগর কর্মচারীদের কয়েকটি রিট আবেদনের রায় একই হয়েছিল। এসব রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল বিভাগে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। আদালতে যাবেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা : মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। সেখানে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক ড. মাহমুদুর রহমানসহ ১৭১ জন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এসব মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকরিতে যোগদানের সময়েই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে চাকরিতে যোগদান করেছেন। এখনো চাকরি করছেন। এ কমান্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তাঁরা নতুন সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। ইতিমধ্যে সিনিয়র কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথাও বলেছেন তাঁরা। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে তাঁরা আদালতের শরণাপন্ন হবেন। কারণ নতুন সংজ্ঞার কারণে ১৭১ জন কর্মকর্তার মধ্যে কমপক্ষে ৮৫ শতাংশ কর্মকর্তা সরকারি মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন, যা তাঁদের সরকারি চাকরি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। মাঠপর্যায়ের মতামত নেওয়া উচিত ছিল : মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, যদি স্বাধীনতার এত বছর পর সরকার কোনো নতুন নিয়ম করতে চায় তবে সারা দেশে মাঠপর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপ করে একটি মতামত নিতে পারত। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও অনেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আছেন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৩ বা ১৪ বছর বয়সেও শারীরিকভাবে সক্ষম হওয়ায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এখন তাঁরাও তালিকা থেকে বাদ পড়বেন, যা তাঁদের জন্য চরম অপমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করার শামিল। যাচাই-বাছাইয়ে ধূম্রজাল : সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১২ বছর ধরে যত মুক্তিযোদ্ধা সরকারি সনদ নিয়েছেন, তাঁদের আবারও উপজেলা পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সঠিকতা প্রমাণের জন্য অনুরোধ করেছি। উপজেলা পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য যদি মুক্তিযোদ্ধা হন তবে তিনি আহ্বায়ক হবেন। আর যদি এমপি নিজে মুক্তিযোদ্ধা না হন তবে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেই কমিটির আহ্বায়ক হবেন। এ ছাড়া ওই কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিও থাকবেন। থাকবেন মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন কমান্ডার ও স্থানীয় সব মুক্তিযোদ্ধারা। সাত সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটির সামনে প্রকাশ্যে সবার সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে উপজেলাভিত্তিক ওই কমিটি এলাকার সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।’ মন্ত্রী বলেন, এ কাজ দুই মাসের মধ্যে শেষ করা হবে। কেউ যদি বাদ পড়ে থাকেন তাঁরা তালিকাভুক্ত হবেন। আর যদি কেউ ভুয়া সনদ নিয়ে থাকেন, তাও আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ২৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, তিন ধরনের মুক্তিযোদ্ধা- যথা ভারতের তালিকা, লাল মুক্তিবার্তা ও প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত সনদধারী ছাড়া অন্য সব গেজেটভুক্ত সব মুক্তিযোদ্ধাকে যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে হাজির হতে হবে। নতুন আবেদনকারীদের প্রত্যেককেই কমিটির সামনে হাজির হতে হবে। যদি তাই হয়, তা হলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের যাঁরা আগের তালিকাভুক্ত তাঁদের শঙ্কার মধ্যে পড়তে নাও হতে পারে। নতুন সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক দূর করার জন্য এ বিষয়টিও সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। মোট মুক্তিযোদ্ধা : এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে এক লাখ ৮০ হাজার গেজেটেড (সনদপ্রাপ্ত) মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। আর গত এক বছরে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন করেছেন আরো এক লাখ চার হাজার জন। নতুন যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে সবাইকে উপস্থিত হতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা আফসোস করে বলেন, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সংজ্ঞা ঠিক করতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। নতুন সংজ্ঞা নিয়েও বিতর্ক রয়ে গেল।
Headlines from most popular newspapers of Bangladesh. বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনামগুলো এক নজরে দেখে নিন।
Wednesday, October 15, 2014
মুক্তিযোদ্ধারা নতুন সংজ্ঞায় হতভম্ব:কালের কন্ঠ
েন। সে সময় তিনি টাঙ্গাইল করটিয়া স্কুলের ছাত্র ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ম্যাট্রিক (এসএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশনে বয়স কমিয়ে ১৪ বছরের কোটায় রাখা হয়। তাই তাঁর বয়স কাগজপত্রে ১৯৭১ সালে ১৩-এর কম হয়ে যায়। তিনি বলেন, এখন নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থাকতে পারবেন না। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বছর ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে যুদ্ধ শেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ১৩ বছরের বালক লালু। সে সময় লালুর সঙ্গে তাঁর সমবয়সী আরো শত শত কিশোর-বালক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই ১৩ বছরের বালক লালু এখন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী সেই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লালু ও তাঁর বয়সী সবাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন! উল্লেখ্য, গত সোমবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ২৫তম সভায় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে যাঁদের বয়স কমপক্ষে ১৫ বছর ছিল তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীর কমপক্ষে ১৭ হাজার মানুষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই বয়স ছিল তখন ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। কিন্তু যারা পড়াশোনা করছিল তাদের বয়স স্কুল থেকে কমিয়ে দেওয়া হয়। এখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দেওয়া বয়সই মাপকাঠি। তা ছাড়া যাঁরা এখন আর চাকরি করেন না তাঁরা সরকারি জন্ম সনদ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে দাখিল করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী নভেম্বর মাস থেকে গত ১২ বছর যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন তাঁদেরও তৃণমূল পর্যায়ে যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে হাজির হতে হবে। নতুন আবেদনেও দেখাতে হবে ১৯৭১ সালে তাঁদের বয়স ছিল কমপক্ষে ১৫ বছর। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের কারণে সরকারি চাকরিতে কর্মরত কয়েক শ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এখন যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত আছেন তাঁদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়বেন। অথচ মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের দায়ের করা কয়েকটি রিট আবেদনেও কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। তাঁদের অবদানের কথাও হাইকোর্টের রায়ে বারবার উঠে আসে। নতুন করে সংজ্ঞা নির্ধারণে উচ্চ আদালতের ওই রায়কেও অবজ্ঞা করা হবে বলে মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও একই ধরনের রায় দেন পরবর্তী সময়ে। ৪৩ বছর পর কেন : মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, পুলিশ, বিজিবি বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থায় যোগদানের সময় বয়স নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সময় তো কোনো বয়সের নির্ধারণ করা ছিল না। তাহলে স্বাধীনতার এত বছর পর কেন বয়স নির্ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ঠিক করা হচ্ছে? জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন রাজিব বলেন, তাঁর বয়সও মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৬ বা এর চেয়ে একটু বেশি ছিল। কিন্তু তৎকালীন ম্যাট্রিক পরীক্ষার কারণে শিক্ষকরা তাঁর বয়স কমিয়ে ১৪ বছর করে দিয়েছিলেন। তিনি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তো বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশরক্ষার চেতনা নিয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় তালিকা, মুক্তিবার্তায় আমাদের নাম আছে। আমাদের সনদ ও গেজেটে নাম আছে। তাহলে কি আমরা বাদ যাব তালিকা থেকে? এটা হতে পারে না।’ আগেই বয়স নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু : নতুন করে সংজ্ঞা নির্ধারণের আগেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধার বয়স ১৫ বছর না হলে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া শুরু করেছে। এমনকি ইতিপূর্বে দেওয়া সনদও বাতিল করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অলিখিতভাবে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লালুকে আদর্শ ধরে এত দিন মন্ত্রণালয় ১৩ বছর বয়সীদের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করে যাচাই-বাছাইয়ের পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার আলোকেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এমন মানদণ্ডকে বয়সের পরিমাপ হিসাবে নিয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশে দেখা গেছে, তারা বাগেরহাট সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারী জগবন্ধু বিশ্বাসের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে দিয়েছে। আদেশে বলা হয়েছে, জগবন্ধুর বয়স প্রত্যাশিত ১৩ বছর না হওয়ায় তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যায়ন করা গেল না। একই সঙ্গে তাঁকে দেওয়া সাময়িক সনদও বাতিল করে দেওয়া হয়। এমন আরো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। উচ্চ আদালতের রায় : ১৯৭২ সালে নিয়োগ দেওয়া মুজিবনগর কর্মচারীদের ছাঁটাই করে চারদলীয় জোট সরকার। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের আবার নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সুপারিশ করে। কিন্তু সরকার এতে গড়িমসি করতে থাকে। পরে ১৯৯৭ সালে ছয়জন কর্মচারী যাঁদের বয়স ১৯৭১ সালে আট থেকে ১০ বছর ছিল, তাঁরা নিয়োগ পাওয়ার জন্য হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন। বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি হাসান আমিন ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই রায় দেন। রায়ে বলা হয়, মুজিবনগর কর্মচারীরা তরুণ বয়সী ছিলেন। তবে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারকে তথ্য সরবরাহ করেন। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ, অস্ত্র সরবরাহ ও বহন, খবর সরবরাহ, অস্ত্র সংরক্ষণ ও পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের অবুঝ মনে করায় অনেক কিছু এড়িয়ে যেত। তাই তাঁরা ঠিকমতো মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। আদালত বারবার উল্লেখ করেন, মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য অবদান রাখায় তাঁদের মুজিবনগরের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের বয়স নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। যাঁরা রিট আবেদন করেছিলেন তাঁরা হলেন মো. আবদুল কুদ্দুস হাওলাদার, মো. সালিম মল্লিক, আবু তালেব মিয়া, আবুল বাশার হাওলাদার, সলিম হাওলাদার ও আবদুর রহিম। এর আগেও মুজিবনগর কর্মচারীদের কয়েকটি রিট আবেদনের রায় একই হয়েছিল। এসব রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল বিভাগে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। আদালতে যাবেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা : মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। সেখানে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক ড. মাহমুদুর রহমানসহ ১৭১ জন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এসব মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকরিতে যোগদানের সময়েই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে চাকরিতে যোগদান করেছেন। এখনো চাকরি করছেন। এ কমান্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তাঁরা নতুন সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। ইতিমধ্যে সিনিয়র কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথাও বলেছেন তাঁরা। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে তাঁরা আদালতের শরণাপন্ন হবেন। কারণ নতুন সংজ্ঞার কারণে ১৭১ জন কর্মকর্তার মধ্যে কমপক্ষে ৮৫ শতাংশ কর্মকর্তা সরকারি মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন, যা তাঁদের সরকারি চাকরি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। মাঠপর্যায়ের মতামত নেওয়া উচিত ছিল : মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, যদি স্বাধীনতার এত বছর পর সরকার কোনো নতুন নিয়ম করতে চায় তবে সারা দেশে মাঠপর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপ করে একটি মতামত নিতে পারত। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও অনেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আছেন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৩ বা ১৪ বছর বয়সেও শারীরিকভাবে সক্ষম হওয়ায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এখন তাঁরাও তালিকা থেকে বাদ পড়বেন, যা তাঁদের জন্য চরম অপমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করার শামিল। যাচাই-বাছাইয়ে ধূম্রজাল : সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১২ বছর ধরে যত মুক্তিযোদ্ধা সরকারি সনদ নিয়েছেন, তাঁদের আবারও উপজেলা পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সঠিকতা প্রমাণের জন্য অনুরোধ করেছি। উপজেলা পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য যদি মুক্তিযোদ্ধা হন তবে তিনি আহ্বায়ক হবেন। আর যদি এমপি নিজে মুক্তিযোদ্ধা না হন তবে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেই কমিটির আহ্বায়ক হবেন। এ ছাড়া ওই কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিও থাকবেন। থাকবেন মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন কমান্ডার ও স্থানীয় সব মুক্তিযোদ্ধারা। সাত সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটির সামনে প্রকাশ্যে সবার সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে উপজেলাভিত্তিক ওই কমিটি এলাকার সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।’ মন্ত্রী বলেন, এ কাজ দুই মাসের মধ্যে শেষ করা হবে। কেউ যদি বাদ পড়ে থাকেন তাঁরা তালিকাভুক্ত হবেন। আর যদি কেউ ভুয়া সনদ নিয়ে থাকেন, তাও আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ২৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, তিন ধরনের মুক্তিযোদ্ধা- যথা ভারতের তালিকা, লাল মুক্তিবার্তা ও প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত সনদধারী ছাড়া অন্য সব গেজেটভুক্ত সব মুক্তিযোদ্ধাকে যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে হাজির হতে হবে। নতুন আবেদনকারীদের প্রত্যেককেই কমিটির সামনে হাজির হতে হবে। যদি তাই হয়, তা হলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের যাঁরা আগের তালিকাভুক্ত তাঁদের শঙ্কার মধ্যে পড়তে নাও হতে পারে। নতুন সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক দূর করার জন্য এ বিষয়টিও সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। মোট মুক্তিযোদ্ধা : এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে এক লাখ ৮০ হাজার গেজেটেড (সনদপ্রাপ্ত) মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। আর গত এক বছরে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন করেছেন আরো এক লাখ চার হাজার জন। নতুন যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে সবাইকে উপস্থিত হতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা আফসোস করে বলেন, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সংজ্ঞা ঠিক করতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। নতুন সংজ্ঞা নিয়েও বিতর্ক রয়ে গেল।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment