কুষ্টিয়ার রশিদ অ্যাগ্রো লিমিটেডের মিনিকেট চাল ঢাকার জনপ্রিয় চালগুলোর মধ্যে একটি। আড়তে এখন এক কেজি রশিদ ব্র্যান্ডের মিনিকেটের দাম পড়ে ৪৫ টাকা। অন্যদিকে একই মানের ভারত
ীয় 'বিজয়ভোগ' ব্র্যান্ডের চালের দাম পড়ে ৪১ টাকা ৫০ পয়সা। প্রতি কেজিতে সাড়ে তিন টাকার পার্থক্যের কারণে ঢাকার মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে রশিদ ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। অন্যদিকে রমরমা অবস্থা ভারতীয় বিজয়ভোগের। দেশি বা ভারতীয়- ভাত হয় দুই দেশের চালেই। দেশি চালের ভাত বরং সুস্বাদু, ঝরঝরে ও দেশবাসীর বেশি পছন্দের। কিন্তু কয়েক মাস ধরে দেশের চালের বাজারে আধিপত্য ভারতীয় চালের। কম দামে ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল আমদানি করা হচ্ছে। ফলে ঢাকাসহ বিভিন্ন আড়তে দেশি চালের বদলে ভারতীয় চাল বিক্রি হচ্ছে বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে চাল উৎপাদনে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশের কৃষকরা। আগের বছরের তিন কোটি ৩৮ লাখ টন থেকে বেড়ে গেল বছর চাল উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৪৪ লাখ টন, যা দেশের চাহিদার জন্য যথেষ্ট। বাড়তি উৎপাদনের কারণে সরকার প্রথমবারের মতো চাল রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে। টনপ্রতি ৪৫০ ডলার দরে শ্রীলঙ্কায় ২৫ হাজার টন চাল রপ্তানির বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। দেশে চাল আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই। পাশাপাশি তেমন কানো প্রতিবন্ধকতা নেই যা চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে পারে। বরং পাশের দেশ হওয়ায় কম পরিবহন খরচ দিয়ে দিনে দিনেই দেশের বাজারে প্রবেশ করানো যায় ভারতীয় চাল। ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সুসম্পর্ক, ফোনে যোগাযোগ, হুন্ডিতে লেনদেন ইত্যাদি 'সুবিধা'র কারণে আমদানি খুব সহজ। এসব কারণে ভারত থেকেও আসছে প্রচুর চাল। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাত লাখ ৮৬ হাজার টন চাল আমদানির ঋণপত্র (লেটার অফ ক্রেডিট বা এলসি) নিষ্পত্তি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। অন্যদিকে গত জুলাই থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছয় লাখ চার হাজার টন চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে, নিষ্পত্তি হয়েছে চার লাখ ৫১ হাজার টনের। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে তিন লাখ ৭৪ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। তবে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মাত্র পাঁচ মাসে আমদানির পরিমাণ গত বছরের কাছাকাছি চলে গেছে। গত জুলাই থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে তিন লাখ ছয় হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। আমদানির বিষয়টি সরকারের তরফ থেকে স্বীকার করা হয়নি। কৃষিমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, যে চাল আসছে তা পোলট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ চাল উৎপাদিত হয় তা দিয়ে চাহিদা পূরণ হওয়ার পরও উদ্বৃত্ত থাকে। কিছু সুগন্ধি চাল ও গো-খাদ্য ভারত থেকে আমদানি করে কিছু ব্যবসায়ী। এতে বছরে যদি চার-পাঁচ লাখ টন চাল আমদানি হয় তা দেশের মোট চাহিদার খুব সামান্য। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। চালের দাম নিয়ে কৃষকের কোনো উৎকণ্ঠা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'চালের মিল মালিকরা একচেটিয়া ব্যবসা করেন। তাঁদের স্বার্থে হয়তো কিছুটা হানি হচ্ছে, কিন্তু এতে চিন্তার কোনো কারণ নেই।' তবে খোদ রাজধানীর বাজারে হিন্দিতে ভারতীয় ব্র্যান্ডের নাম লেখা চাল প্রমাণ করছে, এগুলো খাওয়ার জন্যই আনা হচ্ছে। যদিও দেশের মোট চালের চাহিদার তুলনায় আমদানির পরিমাণ খুব বেশি নয়, তবে আড়তের মালিকরা বলছেন, প্রতিদিন যা বিক্রি হচ্ছে তার বড় অংশ এখন ভারতীয় চাল। দেশি চাল থেকে যাচ্ছে গুদামে। দেশি চালের সরবরাহে কোনো সংকট না থাকলেও যেসব দোকানে দেশি চাল বিক্রি হয় সেসব দোকানে বিক্রিই কম। অন্যদিকে মৌসুমের শেষ দিকে এসে বাজার করছে অস্বাভাবিক আচরণ। বোরো মৌসুমের চালের দাম এখন বাড়ার বদলে কমছে। অন্যদিকে চলতি আমন মৌসুমের চালের দাম বেশ কিছুটা কমে গেছে। অথচ এর আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে, আমন মৌসুমে চালের দাম কমার বদলে বাড়তে থাকে। ভারত থেকে এখন তিন ধরনের চাল আসছে। সরু চালের মধ্যে ভারতীয় বিজয়ভোগ, জনতা, লক্ষ্মীভোগ, প্রতিমা ব্র্যান্ডের মিনিকেট; স্বর্ণা ও বিআর-২৮ জাতের নূরজাহান ব্র্যান্ডের চাল দেখা গেছে ঢাকার আড়তগুলোতে। মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে বেশির ভাগ দোকানেই এখন ভারতীয় চাল বিক্রি হচ্ছে। চালের বস্তার গায়ে হিন্দি ভাষায় লেখা ভারতীয় কম্পানির নাম সহজেই চোখে পড়বে। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের আড়তে প্রতিকেজি ভারতীয় মোটা জাতীয় বিভিন্ন মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩১ টাকা দরে। একই ধরনের দেশি চালের সঙ্গে দামের পার্থক্য দেড় থেকে দুই টাকা। ওই বাজারের বিভিন্ন দোকানে ভারতীয় চাল সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভারতীয় চালের কারণে আড়তে সরু, ভালো মানের মোটা ও মাঝারি মানের চালের দাম কমে গেছে। মিনিকেট চালের দাম কেজিতে এক টাকা, স্বর্ণা দুই টাকা, গুটি দুই টাকা ও নাজিরশাইল চালের দাম চার-পাঁচ টাকা কমেছে। স্থানীয় পর্যায়ে এটা আরো বেশি। স্বর্ণা, গুটি ও নাজিরশাইল চালের দাম কমার একটা কারণ চলতি আমন মৌসুম উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমন মৌসুমে সাধারণত চালের দাম কমে না, কিন্তু এ বছর ভারতীয় চালের কারণে দাম কমেছে। মোহাম্মদপুরের খুলনা রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক নজরুল খন্দকার বলেন, ভারতীয় চাল না থাকলে এখন মোটা চাল ও মিনিকেট চালের দাম বাড়ত, কিন্তু তা কমেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ভারত ১০ কোটি ৫২ লাখ টন চাল উৎপাদন করেছে। অন্যদিকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন করেছে ১০ কোটি ৬২ লাখ। ২০১০-১১ অর্থবছরের উৎপাদন কম হয়েছিল (৯ কোটি ৬০ লাখ টন), এর পর থেকে বেড়েছে। ভারত থেকে চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মুকুল এন্টারপ্রাইজের মালিক মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতে সবচেয়ে কম দামের চালের দাম পড়ে টনপ্রতি ৩০৯ ডলার। মোটা জাতের ওই চালটি বেশি চলে বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে। এ ছাড়া স্বর্ণা জাতের চাল ৩৪০ ডলার ও মিনিকেট চাল ৪৮০ ডলার দরে আমদানি করা যায়। তিনি জানান, মিনিকেট চাল তাঁরা ৩৯ টাকা ৮০ পয়সা, স্বর্ণা ২৭ টাকা ও রত্না ২৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, 'চাল আমরা খুব কম লাভে ছেড়ে দেই। কেজিতে ২০-২৫ পয়সা লাভ হলেই প্রতি ট্রাকে তিন থেকে চার হাজার টাকা হয়। তাতেই আমাদের চলে।' জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, এ বছর বিশ্বব্যাপী চাল সরবরাহের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৮ কোটি ৫২ লাখ টন। আর এর বিপরীতে চাহিদা আছে ৫০ কোটি টনের। ফলে বিশ্ববাজারে চালের দাম আরো কমার আশা করা হচ্ছে। এতে ভারতীয় চাল আরো বেশি পরিমাণে বাংলাদেশে ঢুকে দেশি চালের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশ অটো মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এমন কখনো দেখি নাই যে আমনে চালের দাম এভাবে পড়ে যায়। দেশি চাল বিক্রি না হওয়ায় প্রায় অর্ধেক মিল এখন বন্ধ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী মাসে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে।' তিনি আরো বলেন, 'ভারতীয় চালের দাম কম, দেখতে চকচকে। সেই চাল আগে বিক্রি হচ্ছে। ফলে দেশি চালের চাহিদা না থাকায় মালিকরা মিল বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে ধানের দাম কমে গেছে। এতে কৃষকরা আগামী বোরোতে ধান চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়তে পারে।' মোহাম্মদপুর, কারওয়ান বাজার ও বাবু বাজারের দেশি চালের বিক্রেতারা বলছেন, ভারতীয় চালের কারণে তাঁদের বিক্রি কমে গেছে। কৃষি মার্কেটের ভিআইপি রাইস এজেন্সি মালিক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, 'আমরা ভারতীয় চাল বিক্রি করি না, কিন্তু দেশীয় চালের বাজার খুব খারাপ। আগে দৈনিক গড়ে দুই লাখ টাকার চাল বিক্রি হতো। এখন সেটি এক লাখের নিচে নেমেছে।'
No comments:
Post a Comment