মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারের (এসপি) মধ্যে 'মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব' নিরসন করে মিলেমিশে কাজ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত ২
৩ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র সচিবের বৈঠকে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশকে মিলেমিশে কাজ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দপ্তর ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। পুলিশ সদর দপ্তর ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছ থেকে ডিসি ও এসপিদের প্রতি নির্দেশনা এ সপ্তাহেই পৌঁছাবে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের দ্বন্দ্বের কারণে ফরমালিনবিরোধী অভিযানের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযান ভেস্তে গেছে। শুধু তাই নয়, একের পর এক নানা নির্দেশনাই ভেস্তে গেছে সমন্বয়হীনতার কারণে। কখনো জেলা প্রশাসক এসপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, আবার কখনো পুলিশ সুপার অভিযোগ করছেন জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে। এসব বিষয় নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই টানাপড়েন চলছে। আর এ অবস্থায় সরকারের তরফ থেকে তাঁদের মিলেমিশে কাজ করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২৩ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের মধ্যে 'মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব' কিভাবে কমানো যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দেন কেউ কেউ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয়, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। ইতিবাচক মানসিকতা, মেধা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার প্রয়োগ ঘটিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখা এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সুশীল সেবকের ভূমিকা পালন করতে হবে। এমন সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়। মিলেমিশে কাজ করার বিষয়টি দেশের সব জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে বৈঠকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার ডিভিশনে এ ধরনের ঝামেলা নেই। যদি কখনো সমস্যা দেখা দেয় তাহলে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করা হয়।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এ ধরনের নির্দেশনা মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে। আমরাও দেই। এটি রুটিন ওয়ার্ক।' স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ সিদ্ধান্তের পর গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দপ্তর ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এই নির্দেশনা এ সপ্তাহেই জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে। এ ছাড়া ওই সভায় আলোচনা হয়- বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকরা জনগণের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ বজায় রাখবেন। জনগণের কথা ধৈর্য সহকারে শুনবেন এবং তাদের সমস্যা দ্রুত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাধানের চেষ্টা করবেন। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা পর্যায়ে গঠিত কোর কমিটির সভা অনুষ্ঠানপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে। ওই বৈঠকে সমুদ্রপথে জাহাজে বা নৌকায় করে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর অবৈধ প্রক্রিয়ায় জড়িত আদম ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া শীত মৌসুমে ঘন কুয়াশার কারণে নৌপথে এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং নিবিড় তদারকিমূলক ব্যবস্থা জোরদারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, হাইওয়ে পুলিশ ও নৌ পুলিশ। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কোনো বিশেষ মহল যেন সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অপতৎপরতা রোধে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্যও ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শক ও সব বিভাগীয় কমিশনারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২১ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির তৃতীয় সভায় ফলমূল ও খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন ও বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক এবং ভেজাল মিশ্রণকারীদের বিরুদ্ধে 'খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্য ও ভেজাল মিশ্রণ নিরোধ অভিযান' নামের একটি সমন্বিত অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। ওই পরিপত্রে মেট্রোপলিটন এলাকা, জেলা ও উপজেলায় কমিটি গঠন করে অভিযান পরিচালনা-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে মেট্রোপলিটন এলাকায় কমিটির সভাপতি মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলায় ইউএনওকে করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরিপত্র পাওয়ার পর পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়ার কারণে জেলা প্রশাসকরা ক্ষিপ্ত হন। তাঁদের অনেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানান- পুলিশকে এ দায়িত্ব দিয়ে রুলস অব বিজনেস লঙ্ঘন করা হয়েছে। এটি মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯-এর ৫, ৬, ১১ ও ১২ ধারার পরিপন্থী এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের এখতিয়ারবহির্ভূত। এসব বিরোধিতার কারণে শেষ পর্যন্ত পরিপত্রটি স্থগিত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের দ্বন্দ্বের কারণে সরকারের এমন একটি মহৎ উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।
No comments:
Post a Comment