Saturday, December 6, 2014

কাশিমপুর কারাগার দুর্নীতির কারণে নিরাপত্তাঝুঁকিতে:প্রথম অালো

অনিয়ম, ঘুষ লেনদেন ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়েছে কাশিমপুর কারাগার। শুধু কারাগারে আটক স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে আসা দর্শনার্থীদের কাছ থেকেই মাসে গড়ে ২২ লাখ টাকা ঘুষ হিসেবে আদায় করে থাকে সেখানকার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রধানত এর মাধ্যমেই নিরাপত্তা শৈথিল্য তৈরি হচ্ছে।  সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার গত মাসে দেওয়া প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে ছয়টি গুরুতর অন
িয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বন্দীদের নির্যাতনের চিত্র মোবাইলে ধারণ করে তা তাদের স্বজনদের দেখিয়ে অর্থ আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগও আছে। প্রতিবেদনে একে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজীপুরের কাশিমপুরে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীমউদ্দিন রাহমানিয়া, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ভারপ্রাপ্ত আমির সাইদুর রহমানসহ দেড় শতাধিক জঙ্গি, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ১৩ আসামি, রাজনৈতিক নেতা, ভিআইপিসহ প্রায় পাঁচ হাজার বন্দী রয়েছেন। কিন্তু নির্দেশনা থাকলেও আদালতে আনা-নেওয়ার সময় তাঁদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। আর্থিক অনিয়মের কারণে নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এ বিষয়টিকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনটিতে কারাগারের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি তাঁদের শুধু অভ্যন্তরীণ চারটি কারাগারে (ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১, পার্ট-২, হাই সিকিউরিটি ও মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার) বদলি না করে দেশের অন্যান্য কারাগারে বদলির সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করে কারাগারের অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে গঠিত কমিটির প্রধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শওকত মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেভিওয়েটরা প্রলোভিত করেন, আর প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে যান কর্মকর্তারা।’ কিছু কর্মকর্তা অনিয়ম করেন স্বীকার করে তিনি বলেন, অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এসব বিষয়ে আরও তদন্ত করে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনিয়মের অভিযোগ: প্রতিবেদনে বলা হয়, কারারক্ষীরা বন্দীদের নির্যাতন করে সে ছবি মুঠোফোনে ধারণ করে রাখেন। তারপর বন্দীদের আত্মীয়স্বজনদের সে ছবি দেখিয়ে টাকা আদায় করেন। শুধু দর্শনার্থীদের কাছ থেকেই মাসে সর্বনিম্ন ১৬ লাখ এবং সর্বোচ্চ ২৮ লাখ টাকা (গড়ে ২২ লাখ) আদায়ের খাতওয়ারি একটি হিসাবও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। এর মধ্যে পার্ট-২ কারাগার থেকেই আট থেকে ১২ লাখ টাকা আদায় করা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে গুনতে হয় ২০০-৫০০ টাকা। ভিআইপিদের ক্ষেত্রে অবস্থা বুঝে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা এবং হাসপাতালের কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করতে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হয়। আবার আদালত থেকে মুক্তি মিললেও বের হওয়ার সময় নানা ঝামেলায় পড়তে হয় কয়েদিদের। জামিনে বা খালাস পেয়ে মুক্তি পেলে কয়েদিদের জমা পাওনা দেওয়া হয় না। জামিনের বন্ড বা কাগজে সমস্যা আছে বলে বন্দীভেদে দুই থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। কয়েদিদের নিজ জেলায় বা পছন্দের কারাগারে স্থানান্তর করার আবেদন করলে তাদের বিভিন্ন অজুহাত তুলে কারা আইনে অপরাধী বানিয়ে পরে তাঁদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে স্থানান্তর করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুর্নীতির সুযোগে কারারক্ষীরাও নানা ধরনের সুযোগ নেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। জেলারদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: কাশিমপুরের চারটি কারাগারের প্রতিটির জন্য পৃথক জেলার ও জেল সুপার রয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে জেলাররা মাসে ২০-৪০ হাজার টাকা মাসোহারা আদায় করেন। প্রতিটি কারাগারে দুটি করে ক্যানটিন রয়েছে। একটি কারাগারের ভেতরে, অন্যটি বাইরে। বাইরের ক্যানটিন থেকে জেলাররা মাসে ২০ হাজার, আর ভেতরের ক্যানটিন থেকে ৫০ হাজার টাকা মাসোহারা নেন। ভেতরের ক্যানটিনে কয়েক গুণ বেশি দামে কয়েদিদের কাছে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করা হয়। পুরো প্রতিবেদনে কেবল হাইসিকিউরিটি কারাগারের জেলার জান্নাতুল ফরহাদের নাম উল্লেখ করে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। গত পবিত্র ঈদুল আজহার সময় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় কারাগারে আটক শিবিরের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে তিনি গাড়ি ভাড়ার টাকা নিয়েছেন। জানতে চাইলে জান্নাতুল ফরহাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অভিযোগের সামান্যতম সত্যতা প্রমাণ করতে পারলে চাকরি ছেড়ে দেব। ১৫ বছর পর আমি বাড়িতে গেলাম। এর জন্য অন্যের সহায়তা নিতে হয়?’ তিনি বলেন, ‘দেড় মাস ধরে আমাদের এখানে একটি গোযেন্দা সংস্থা কাজ করেছে। তাদের একজন কর্মকর্তা আমার কাছে একটি তালিকা চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি দিতে পারিনি। তাই বিদ্বেষমূলক আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন।’ তবে কারাগারে কিছু অনিয়ম হচ্ছে স্বীকার করে কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারের এই জেলার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু বন্দী কারাগার থেকে কথা বলার চেষ্টা করেন। আর এর সঙ্গে আমার কিছু কারারক্ষী জড়িত। কারাগারে কিছু মাদকও পাওয়া গেছে। আমি গত এক বছরে ৯৩ জন কারারক্ষীকে সাজা দিয়েছি।’ নিরাপত্তার ঘাটতি: দেশের শীর্ষ তিন জঙ্গি সংগঠনের নেতাকে আদালতে আনা-নেওয়ায় বাড়তি নিরাপত্তার কথা বলা হলেও তাঁদের প্রচলিত নিরাপত্তাতেই আনা-নেওয়া করা হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহের ভালুকায় এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে জেএমবির তিন শীর্ষ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার উদাহরণ দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে কারাগার থেকে কয়েদি আনা-নেওয়ার ব্যবস্থায় বিশেষ ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়। কাশিমপুরের কারাগারগুলোতে ঢোকা বা বের হওয়ার ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় ফটক দিয়ে। এতে ত্রুটি দেখা গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। দর্শনার্থীদের আসা-যাওয়ার তথ্য যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হয় না। কারাগারের ভেতরে একটি বিদ্যালয় রয়েছে। ওই বিদ্যালয়ের কারণে প্রতিদিন সকালে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটে। এ ছাড়া আদালতের গারদে আত্মীয় পরিচয়ে জঙ্গি সংগঠনের অনুসারীরা তাঁদের সঙ্গে দেখা করে দিকনির্দেশনা নেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কারাগারের গাড়িতে এবং আদালতের গারদে বন্দীদের একসঙ্গে অবস্থানকেও ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। কারাগার থেকে গাড়িতে ওঠানোর সময় হাতকড়া পরানোর কথা থাকলেও অনেক সময় তা করা হয় না। আদালত প্রাঙ্গণে নামানোর সময় পরানো হয়। এ ছাড়া প্রিজন ভ্যানগুলোর অধিকাংশক নড়বড়ে ও পুরাতন হওয়ায় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বলা হয়। কারাগারের মোবাইল জ্যামার ঠিকমতো কাজ করে না বলে অর্থের বিনিময়ে কয়েদিদের কথা বলার সুযোগ করে দেন কারারক্ষীরা। শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও নানা কায়দায় কারাগারের ভেতরে সিমকার্ড নিয়ে যান। হাজতি-কয়েদিদের আদালতে যাতায়াতে পাহারার গাড়িগুলো ভাড়ায় আনা, অপরিচিত চালকের ওপর নির্ভর করা, জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করায় পালিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। প্রতিবেদনে কাশিমপুর কারাগারের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়। বিশেষ করে কারাগার থেকে আদালতে জঙ্গি কয়েদিদের আনা-নেওয়ার সময় সামনে-পেছনে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা, হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরানো নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়। এ ছাড়া কারাগারের জনবল বৃদ্ধি, মেটাল ডিটেক্টর, মোবাইল জ্যামার, সিসি ও আইপি ক্যামেরা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য তাঁদের বায়োডাটা সংগ্রহ, কাউকে সন্দেহ হলে মোবাইল নম্বর রেখে ট্র্যাকিংয়েরও সুপারিশ করা হয়।

No comments:

Post a Comment