পেরুর রাজধানী লিমায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যে কপ-২০ জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে অংশ নিচ্ছেন মোট ১৯৬টি দেশের প্রতিনিধি। এঁদের মধ্যে যেমন আছেন সরকারপ্রধান, তেমনি আছেন মন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা। আছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞসহ নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতবিদ্য ব্যক্তিরা। তবে বৃহস্পতিবার এঁদের সবাইকে ছাপিয়ে যার উপস্থিতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। বৃ
হস্পতিবার প্রথমবারের মতো সম্মেলনকেন্দ্রের মূল আলোচনা সভায় জন কেরি বক্তব্য দেন। ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ছিল আমলা অথবা কারিগরি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে। কেরির এই উপস্থিতিকে তাই অনেকেই বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি রোধে যুক্তরাষ্ট্রের, বিশেষত প্রেসিডেন্ট ওবামার রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রকাশ বলে মনে করছেন। জন কেরি তাঁর ভাষণে শ্রোতাদের নিরাশ করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান নেতৃত্বের অনেকেই বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি বা এর বিপদের বিষয়টি সত্য বলেই স্বীকার করেন না। তাঁদের নাম উল্লেখ না করলেও জন কেরি প্রশ্ন রাখেন, এই সংকট যাঁরা অস্বীকার করেন, তাঁরা যদি মিথ্যা প্রমাণিত হন, তাহলে কী হবে? মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে যে প্রমাণ মিলেছে, বিবেকসম্পন্ন কেউ তা উপেক্ষা করতে পারে না। বৈশ্বিক উষ্ণতা মানুষেরই সৃষ্টি, এর জন্য মুখ্যত দায়ী কয়লা ও তেলের মতো জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি। উন্নয়নশীল দেশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, শিল্পোন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক অগ্রগতির নামে এ ধরনের জ্বালানিনির্ভর হয়ে যে ভুল করেছে, সেই একই ভুল যদি তারাও করে, তাহলে পৃথিবী আরও গভীর সংকটে পড়বে। কেরি দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা মাথায় রেখে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এবারের সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি সীমিত রাখার যে ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছে, তা হাতছাড়া না করার আবেদন জানান। মূল মঞ্চে সরকারি প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে কেরি তাঁর বক্তব্যের জন্য বিস্তর সাধুবাদ পেলেও আলোচনাকেন্দ্রের বাইরে যে কয়েক হাজার বেসরকারি জলবায়ু কর্মী পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশ নিচ্ছেন, তাঁরা সে বক্তব্যের সমালোচনা করেন। এঁদের সবচেয়ে বড় আপত্তি, কেরি তাঁর ভাষণে একবারও বিতর্কিত কিস্টোন পাইপলাইনের কথা উত্থাপন করেননি। এই পাইপলাইনের মাধ্যমেই কানাডা থেকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত ‘ফ্র্যাকিং’ পদ্ধতিতে আহরিত গ্যাস ও তেল যুক্তরাষ্ট্রে আমদানির ব্যাপারে রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যরা ওবামা প্রশাসনের ওপর চাপ দিয়ে আসছেন। কেরির নীরবতাকে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক ফ্র্যাকিংয়ের পক্ষে নীরব সম্মতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। উল্লেখসংখ্যক তরুণ সম্মেলনকেন্দ্রের বাইরে কেরির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। কেরির বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে দেওয়া মার্কিন জলবায়ুকর্মীদের একটি বিকল্প প্রস্তাব জাতিসংঘ গ্রহণে সম্মত হয়নি বলে ইউএস ক্লাইমেট অ্যাকশনের একজন প্রতিনিধি সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ আমাদের বক্তব্য উপস্থাপনে বাধা দেবে ও তা সেন্সর করবে, এটা একদম অভাবিত।’ শুধু কেরি নয়, যুক্তরাষ্ট্রের তেল লবির কয়েকজন প্রতিনিধির বক্তব্যেরও প্রতিবাদ করেছেন জলবায়ুকর্মীরা। জন কেরি ছাড়া অন্য যে মার্কিন অতিথি দর্শক-শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হন, তিনি হলেন সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী পরিবেশবাদী হিসেবে পরিচিত আল গোর। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি রোধে আশু আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে তাঁর আবেগঘন বক্তব্য সম্মেলনকক্ষের ভেতরে ও বাইরে বিপুলভাবে আদৃত হয়। মার্কিন অতিথিদের এই কোলাহলময় উপস্থিতি অন্য আরেক কারণেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মূল সম্মেলনটি বসেছে পেরুর সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরের অংশবিশেষে, সরকারিভাবে যে ভবনের নাম ‘এলপেন্তাগনিতো’, বা ‘খুদে পেন্টাগন’। জলবায়ুকর্মীদের কেউ কেউ সে কারণে পুরো ব্যাপারটিকে একটি পরিহাস বলে অভিহিত করেছেন। উল্লেখ্য, সরকারি সম্মেলনের পাশাপাশি এই লিমাতেই একটি ‘জনতার জলবায়ু সম্মেলন’ বসেছে, যাঁরা ‘এলপেন্তাগনিতার’ আলোচনাকে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মূল সম্মেলনে একটি চূড়ান্ত খসড়া চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে আলোচনা ও দর-কষাকষি অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘ সূত্র জানিয়েছে, নিঃসরণ ও অর্থায়নের প্রশ্নে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব এখনো দূর হয়নি। তবে সম্মেলন সচিবালয় থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল শুক্রবার অর্থাৎ শেষ দিনের মধ্যে একটা খসড়া দলিল গৃহীত হবে। সব পক্ষই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খসড়া চুক্তিটি অনুমোদনের লক্ষ্যে সমঝোতার কথা বলছে, যদিও তার ফলে মূল চুক্তিটি দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আলোচনায় জটিলতা যে প্রায় শেষ মুহূর্তে এসেও কাটেনি, তার আভাস মেলে ইউরোপীয় কমিশন প্রধান মিগেল আরিয়াস কানেতের এক বক্তব্য থেকে। বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের কানেতে বলেন, ‘আলোচনা পথ হারায়নি, তবে তা এগোচ্ছে খুবই ধীরগতিতে।’ কানেতে জানান, অধিকাংশ অনুচ্ছেদই অমীমাংসিত। সদস্য দেশগুলো এখনো বিভিন্ন অনুচ্ছেদের ওপর তাদের সংশোধনী প্রস্তাব করে যাচ্ছে। তিনি জানান, কোনো কোনো অনুচ্ছেদে ১১ বা তার বেশি বিকল্প প্রস্তাব রয়েছে। এই মতভিন্নতা কাটিয়ে একটি সর্বসম্মত খসড়া গ্রহণের মাধ্যমে গতকালই বাংলাদেশ সময় গভীর রাতে সম্মেলন শেষ হওয়ার কথা। তবে চুক্তি চূড়ান্ত না হলে আলোচনা হয়তো আরও এক দিন বাড়ানো হবে। আগেও এ রকম হয়েছে। লিমা চুক্তির একটি মূল লক্ষ্য সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ মাত্রা নির্ধারণ। ১৯৯৭ সালে গৃহীত কিয়োটো প্রটোকলে শুধু উন্নত দেশগুলোকে নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চলতি খসড়ায় উন্নত ও উন্নয়শীল উভয় দেশকেই ঐচ্ছিক ভিত্তিতে নিঃসরণ মাত্রা নির্ধারণের সুযোগ রাখা হতে পারে। চীন, ভারত ও ব্রাজিল তাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, এসব দেশ এখন গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রধান উৎস, সে কারণে এই সংকট নিরসনে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। নিজেদের দায়িত্ব স্বীকার করে ব্রাজিল একটি নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এর লক্ষ্য, উন্নত বিশ্বের নিঃসরণমাত্রা নির্ধারণের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে স্তরভিত্তিক নিঃসরণ-প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা। এই প্রস্তাব অনুসারে, উন্নয়নের একটি নির্ধারিত মাত্রা অর্জনের পর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পর্যায়ক্রমে নিঃসরণচক্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
No comments:
Post a Comment