সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া জাহাজের তেল ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ইতিমধ্যে অন্তত আটবার জোয়ার-ভাটা হয়েছে। এর সঙ্গে তেল ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। শেলা নদীর আশপাশের
নালা-খালে ভাসছে তেল। পানির ওপর আলকাতরার মতো থকথক করছে তেলের আস্তর। জোয়ারের টানে সেই তেল বনে ঢুকে ঢেকে দিয়েছে শ্বাসমূল। নদীর পাড়ের লতা-গুল্ম, বাইন, কেওড়াসহ অন্য গাছপালার গায়ে লেগে আছে তেলের কালো দাগ। নদীর পানিতে কোথাও কোথাও ইতিমধ্যে মরা মাছের দেখা মিলছে। তেলের কারণে বনের জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি নদীর পাড়ের মানুষও বিপদে পড়েছে। নদীর মিঠা পানিতে এভাবে তেল মিশে যাওয়ায় স্থানীয় লোকজন তা কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারছে না। দুর্ঘটনার পর ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনো উদ্ধারকাজ শুরু হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ কাণ্ডারি-১০ সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা হয়েছে গতকাল বুধবার। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর নাগাদ সেটি দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) দুটি উদ্ধারকারী জাহাজও গতকাল রওনা হয়েছে। বরিশাল থেকে রওনা দিয়েছে ‘নির্ভীক’ আর নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা হয়েছে ‘প্রত্যয়’। তবে সেগুলো কখন পৌঁছাবে সংশ্লিষ্টরা তা বলতে পারছে না। নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী জাহাজ ‘আখতারউদ্দীন’ ও ‘শাহপরান’ও দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। তেলবাহী ট্যাংকারসহ জাহাজডুবির ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি করা হয়েছে। বন বিভাগ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর আলাদাভাবে এসব কমিটি গঠন করেছে। তবে ডুবে যাওয়া জাহাজের মাস্টার মোখলেসুর রহমানের খোঁজ গতকাল দুপুর পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। নৌবাহিনীর ডুবুরিদল তাঁকে খুঁজছে। তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় বন বিভাগ মংলা থানায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে। গত মঙ্গলবার বন বিভাগের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এতে ডুবে যাওয়া জাহাজ ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ এবং এ জাহাজকে ধাক্কা দেওয়া জাহাজ এমটি টোটালের মালিককে আসামি করা হয়েছে। এমটি টোটালকে গতকাল ভোলায় আটক করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংকার দুর্ঘটনায় তেল নিঃসরণের পর সুন্দরবনে শেলা নদী রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গতকাল রাতে নৌ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে এক জরুরি আন্তমন্ত্রণালয় সভায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শেলা নদী রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ট্যাংকারকে ধাক্কা দেওয়া জাহাজ এমটি টোটালকে গতকাল ভোলায় আটক করে তার সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন সনদ স্থগিত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ গত মঙ্গলবার পূর্ব সুন্দরবনের মৃগমারী এলাকার শেলা নদীতে ডুবে যায়। ভোরে ঘন কুয়াশার মধ্যে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। জাহাজটির ট্যাংকারে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল। দুর্ঘটনায় সব তেল নদীতে ভেসে গেছে। গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে তেল নিয়ে যাচ্ছিল ট্যাংকারটি। গতকালও দুর্ঘটনাকবলিত ট্যাংকারটির সামনের অংশ নদীতে ডুবে ছিল। পেছনের অংশ ভাসছিল পানির ওপর। তেলবাহী জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুন অ্যান্ড কম্পানির ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন গতকাল জানান, জাহাজটি উদ্ধার করতে মালিকপক্ষ দুটি জাহাজ এনেছে। সকালে ডুবুরি নামিয়ে ডুবে যাওয়া জাহাজটির সঙ্গে দড়ি বাঁধা হয়েছে। আরেকটি বার্জকে খবর দেওয়া হয়েছে। সেটি পৌঁছালেই টেনে তোলার চেষ্টা করা হবে। গতকাল সকাল ১১টায় মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের সর্বশেষ জনপদ জয়মণির গোলে পৌঁছলে চোখ পড়ে বাঁ দিকের সুন্দরবনসংলগ্ন খালের দিকে। সবে জোয়ারের পানি আসতে শুরু করেছে। সেই পানিতে ভাসছে কালো রঙের জমাট তেল। তাতে খালপাড়ের পলিমাটির রং বদলে কালো চেহারা নিয়েছে। আরেকটু এগিয়ে শেলা নদীর পাড়ের বনের দিকে তাকালে যত দূর চোখ যায় তত দূর গাছের একটি নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত সরল রেখার মতো দাগ দেখা যায়। ওই রেখা পর্যন্ত একেবারে নিকষ কালো। একটু এগোলেই চাঁদপাই ফরেস্ট অফিস, নদীপাড়ে জেটি। সেখান থেকে ট্রলারে শেলা নদীতে ট্যাংকারডুবির ঘটনাস্থলের দিকে এগোলে মনে হয় মাটিতে কেউ যেন কালো রঙের একটি আস্তর দিয়ে রেখেছে। চোখে পড়ে তেলে পোড়া ভাসমান শেওলা, নদীপাড়ের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বিবর্ণ শ্বাসমূল, লতাগুল্মের কালো আবরণ। এভাবে নদীপথে পাঁচ কিলোমিটার গেলে দেখা মেলে সেই ডুবন্ত জাহাজ। জাহাজের মালিকপক্ষ আরো দুটি জাহাজ দিয়ে বেঁধে রেখে ডুবন্ত জাহাজটিকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, যাতে সহজে সেটিকে তোলা যায়। সেখানেই কথা হয় ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ কম্পানির সুপারভাইজার ওয়ালিউল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁরা জাহাজটি উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। সব তেলই ভেসে গেছে বলে মনে হয়। ঘটনাস্থলে নৌবাহিনীর একটি জাহাজও দেখা যায়। এ ছাড়া বন বিভাগ, মংলা বন্দর এবং বিআইডাব্লিউটিএর কর্মকর্তারাও ছিলেন। বিআইডাব্লিউটিএর উপপরিচালক মো. আশরাফ হোসেন বলেন, তাঁদের দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ নির্ভীক ও প্রত্যয় বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আসছে। কিন্তু কখন এসে পৌঁছাবে তা তিনি বলতে পারেননি। তেল কী পরিমাণ এলাকায় ছড়িয়েছে জানতে চাইলে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের কর্মকর্তা আমীর হোসেইন চৌধুরী বলেন, তেল শেলা নদী ছাড়িয়ে পশুর পর্যন্ত পৌঁছেছে। আর শেলাসংলগ্ন খালগুলো দিয়ে তা বনের গভীরে গেছে। তিনি বলেন, শেলা নদীটি পূর্ব-পশ্চিম পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এবং সংলগ্ন দুই পাড়ের কমপক্ষে এক কিলোমিটার পর্যন্ত তেল ছড়িয়েছে। ভাটার সময় তা দৃশ্যমানভাবে ফুটে উঠছে। আর জোয়ার-ভাটার টানে তেল আরো দূর পর্যন্ত গেছে। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত তেল ছড়িয়েছে। তেলে ঢাকা পড়েছে শ্বাসমূল, লতা-গুল্ম, নদীপাড়ের বাইন, কেওড়া ও অন্যান্য গাছপালা। ঘটনাস্থলে থাকা মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার মো. ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘এটি আমাদের চ্যানেলভুক্ত এলাকা নয়। আমাদের জানা মতে, এ নদীর গভীরতা কম।’ ডুবন্ত জাহাজটি উদ্ধার করা সম্ভব, তবে তাঁদের কোনো উদ্ধারকারী জাহাজ নেই। অবশ্য মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া বললেন, ‘শেলা নদী আমাদের চ্যানেল না হলেও সুন্দরবন আমাদের। এ কারণে আমরা প্রয়োজনীয় যেকোনো সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছি।’ তিনি বিষয়টি নিয়ে নৌবাহিনী, বিআইডাব্লিউটিএ ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঘণ্টা দুই ঘটনাস্থলে অবস্থানের পর দুপুর ২টার দিকে আবারও ট্রলারযোগে ফেরার সময় দেখা গেল, জোয়ারের পানিতে নদী টইটম্বুর। যাওয়ার সময় যেসব গাছপালা, পলিমাটিতে তেলের আস্তর চোখে পড়েছিল তা আবারও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। চাঁদপাই স্টেশনের জেটি ঘাটে নামার সময় কথা হয় স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ও ফরেস্টার মো. তৌহিদুর রহমানের সঙ্গে। তাঁরা একটি ডিঙি নৌকায় কালো রঙের তরলের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, ‘ওই নৌকায় ভাসমান তেল নেট জালে আটকে জমা করে রাখা হয়েছে।’ আক্ষেপের সুরে তাঁরা বলেন, ‘আমাদের লোকবল থাকলে আমরা এভাবে কিছুটা হলেও তেল ধরে রাখতে পারতাম।’ বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, শেলা নদীতে যুক্ত খালগুলোতে ভেসে আন্ধারমানিক, নন্দবালা, জয়মণি, হরিণটানা এলাকার ছড়িয়ে পড়েছে তেল। রূপসা নদীতেও তেলের স্তর ভাসার খবর পাওয়া গেছে। গতকাল বিকেল ৩টায় পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার রাকিবুর রহমান ও প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সুন্দরবনের পথে কাণ্ডারি-১০ চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক আসিফ সিদ্দিকী জানান, শেলা নদীতে ছড়িয়ে পড়া তেলের দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে গতকাল দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রওনা হয়েছে উদ্ধাকারী জাহাজ কাণ্ডারি-১০। তবে জাহাজটির কার্যকারিতা নির্ভর করছে দুর্ঘটনাস্থলের পানির গভীরতার ওপর। বন্দর সূত্র জানায়, কাণ্ডারি-১০ জাহাজটি দূষণ রোধ ও উদ্ধারকাজে বেশ পারদর্শী। এ জাহাজের ট্যাংকারে তেলের দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী ১০ হাজার লিটার রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। এক লিটার রাসায়নিক দিয়ে ১০০ বর্গমিটার এলাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ট্যাংকারের পুরো তেল দিয়ে একবার কমপক্ষে ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকার তেলের দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমোডর এম শাহজাহান বলেন, ‘কাণ্ডারি-১০ জাহাজটি দুই দিক থেকে দুটি বুম বের করে ১০ মিটার এলাকাজুড়ে রাসায়নিক ছিটিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছবে। এতে ছড়িয়ে পড়া তেলের দূষণের মাত্রা অনেকটাই কমবে। ট্যাংকারের রাসায়নিক দিয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ মেট্রিক টন দূষিত তেলের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। একই সঙ্গে জাহাজটি উদ্ধারেও সহায়তা দেবে।’ বিআইডাব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ও নির্ভীক ছাড়াও নৌবাহিনী মংলা থেকে ‘শাহপরান’ এবং হিরণ পয়েন্ট থেকে ‘আখতারউদ্দীন’ ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। শাহপরানে ১০ জন ডুবুরি রয়েছেন। তদন্তে দুই কমিটি গঠন তেলবাহী ট্যাংকারডুবির ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। গতকাল সচিবালয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের এ কথা জানান। কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম মাইনুদ্দিন হাসান ও অধিদপ্তরের খুলনার অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিদর্শনালয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ আবু জাফর মিয়া। কমিটি দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়, দুর্ঘটনায় দায়ীদের শনাক্ত করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা কিভাবে রোধ করা যায় এর সুপারিশ দেবে। ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। নৌমন্ত্রী জানান, যে জাহাজের ধাক্কায় তেলবাহী জাহাজটি ডুবে গেছে সেটি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডুবে যাওয়া জাহাজটি উদ্ধারের জন্য দুটি উদ্ধারকারী জাহাজসহ তিনটি জাহাজ পাঠানো হয়েছে। তবে কুয়াশার কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক বেলায়েত হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বন বিভাগের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ও ঢাংমারী স্টেশন কর্মকর্তা প্রহ্লাদ চন্দ্রকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment