Thursday, December 25, 2014

বিমানে ৮৬৫ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি:প্রথম অালো

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১৫টি খাতে ৮৬৫ কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শুধু জিএসই (গ্রাউন্ড সাপোর্ট ইকুইপমেন্ট) শাখাতেই পাঁচ বছরে অর্ধেকের বেশি দুর্নীতি হয়েছে। বিমানের অভ্যন্তরীণ তদন্তে এর প্রমাণ মিলেছে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ শাখার মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আমিনুল ইসলামকে বদলি করে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বিমান সূত্র জানায়, আমিনুল ইসলাম সাবেক ম
হাজোট সরকারের (২০০৯-২০১৩) ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিমের (হিরা) জামাতা। তিনি ২০ বছরের অধিক সময় জিএসই শাখায় কর্মরত থেকে নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন। ২০০৯ সালে শ্বশুর মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর দাপট আরও বেড়ে যায়। যত দিন শ্বশুর মন্ত্রী ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর শ্বশুর আর মন্ত্রী হননি। এরপর চলতি বছরের মাঝামাঝি তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বিমানের সাবেক পরিচালক (গ্রাহকসেবা) জর্জ রি-লিভার্স। বিমানের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে বিমানের জিএসই শাখা। অদক্ষতার বদনাম সত্ত্বেও এটি বিমানের সবচেয়ে লাভজনক খাত। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজের মানোন্নয়নে গত পাঁচ বছরে ৪৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় দুর্নীতির মাধ্যমে এ টাকার বড় অংশ লোপাট হয়েছে। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিভাগের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ তদন্ত করে। তদন্ত প্রতিবেদনে আমিনুলকে সম্প্রতি মোটর ট্রান্সপোর্ট (এমটি) শাখার জিএম পদে বদলি করা হয়। বিমানের পরিচালক (প্রশাসন) রাজপতি সরকার প্রথম আলোকে বলেন, জিএম আমিনুলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র তৈরি করা হয়েছে। এখন এ বিষয়ে শুনানি চলছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কেনাকাটায় টিএলডি নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিতে জিএম আমিনুল দরপত্রের নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, যার ফলে কোনো যন্ত্র ক্রয়ে দরপত্র ডাকলে তাতে কেবল টিএলডিই যোগ্য বলে প্রমাণিত হয়। আর এই কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট যে প্রতিষ্ঠানটি, তাতে বেনামে আমিনুলের মালিকানা রয়েছে বলে তদন্ত কমিটি তথ্য পেয়েছে। টিএলডি থেকে সর্বশেষ আটটি গ্রাউন্ড পাওয়ার ইউনিট (জিপিইউ) কেনা হয় প্রায় ৮ কোটি টাকা দামে। দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে টিএলডি থেকে অতিরিক্ত দামে এসব কেনা হয়। শুধু তা-ই নয়, এ ক্ষেত্রে জালিয়াতিরও আশ্রয় নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বলে আটটি জিপিইউ সরবরাহ করা হলেও পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে এর দুটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি, ছয়টি চীনের তৈরি। পরে চীনের তৈরি যন্ত্রগুলোর আইডি প্লেট খুলে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বলে নকল প্লেট সংযুক্ত করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালে ইতালীয় কোম্পানি ফ্রেশিয়াকে ব্যবসায়িক সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ওই কোম্পানির এদেশীয় এজেন্ট করিয়েছেন আমিনুলের পছন্দের একটি প্রতিষ্ঠানকে। এরপর এক বছরে ওই কোম্পানি থেকে বিনা প্রয়োজনে সোয়া দুই কোটি টাকার পুশ কার্ডের যন্ত্রাংশ কেনা হয়। আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্যগুলো ভুল। এসব কেনাকাটায় ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ আছে। শ্বশুরের মন্ত্রিত্বের দাপট কাজে লাগানোর অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি। কেনার পরপর যন্ত্রপাতি বিকল: প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, জিএসই শাখায় গত পাঁচ বছরে ৪৪৩ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এর কোনো কোনোটা কিছুদিনের মধ্যেই বিকল হয়ে পড়ে। দুটি এসিভ্যান ও দুটি মিনি ফর্কলিফট কেনার দুই মাস পর, দুটি জিপিইউ দেড় মাসের মধ্যে, চারটি পুশকার্ড তিন মাস পর ও ১০ ফুট বাই ১০ ফুট মাপের ৬০টি ট্রলি ছয় মাসের মধ্যে বিকল হয়ে যায়। ৩৬ কোটি টাকা দিয়ে কেনা চারটি সিপিএল মেশিন প্রায়ই বিকল থাকে। নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭৮৬ মার্কিন ডলারে তিনটি এয়ার স্টার্ট কাট কেনা হয়। কিছুদিন পর একটি অচল হয়ে যায়। এক বছরের ওয়ারেন্টি থাকা সত্ত্বেও সেটা আদায় করা হয়নি। নিজেরাও মেরামত করতে পারেনি। এ যন্ত্র বাবদ বিমানের ১ কোটি ৬ লাখ টাকা ক্ষতি হয় বলে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিএজি) এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সিএজি কার্যালয়ের সম্প্রতি তৈরি হওয়া এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানের জিএসই শাখার ২০১১-১২ অর্থবছরের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মোট ২২টি জিপিইউর মধ্যে শুধু ১০টি চালু ছিল। সাতটি এসিভ্যানের মধ্যে চালু ছিল দুটি মাত্র। ব্যাগেজ টো-ট্যাক্টর ৪৩টির মধ্যে চালু ছিল শুধু ১৬টি। টয়লেট ফ্লাশ কার্ড সাতটির চারটি অচল ছিল। কিন্তু নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনায় এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ২০১১-১২ অর্থবছরে বিমানের ৪ কোটি ৬২ লাখ ৫২ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ বিষয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ বলেছে, ওই সব যন্ত্র সাময়িক অচল থাকলেও সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। জানতে চাইলে সাবেক বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের বলেন, তিনি মন্ত্রী থাকাকালে জিএসই শাখার দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কাজের মান উন্নয়নের জন্য একাধিকবার তাগাদা ও সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। বিমানের পরিচালনা পর্ষদ সর্বেসর্বা হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষে তখন আর কিছু করাও সম্ভব হয়নি। অবশ্য পরিচালক (প্রশাসন) দাবি করেন, জিএসই শাখার অনিয়ম বন্ধ ও মান উন্নয়নে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রক্ষিতে এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং কিছু কার্যক্রম চলমান আছে। আরও ৪২২ কোটি টাকার ক্ষতি: সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষায় ২০১১-১২ অর্থবছরে বিমানের ১৪টি খাতে ৪২২ কোটি ৭২ লাখ টাকার অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। প্রচলিত আর্থিক বিধিবিধান ও নীতিমালা অনুসরণ না করা, দরপত্রে অনিয়ম, চুক্তি মোতাবেক কাজ সম্পাদন না করার কারণে এসব আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিমানের প্রকৌশল শাখার অবহেলার কারণে দুটি এয়ারবাসের মেরামতকাজ চুক্তিবদ্ধ ৩৮ কার্যদিবসের পরিবর্তে অতিরিক্ত ৩৩১ দিন লাগানো হয়েছে। এতে বিমানের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ১৮৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে ২০১১-১২ অর্থবছরে কেবিন ক্রুদের ৫৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত ফ্লাইং আওয়ার বিল দেওয়া হয়েছে। বিলম্বিত ফ্লাইটের প্রকৃত যাত্রী যা ছিল, তার চেয়ে অধিক যাত্রী দেখিয়ে ৭৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছে। বিমানের কার্গো কমপ্লেক্সে (আমদানি) আগত পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায় না করায় একই অর্থবছরে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১১ সালের জুলাইয়ে কুকা ট্রাভেলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কলকাতায় টিকিট বিক্রয়ে এজেন্ট নিযুক্ত করে বিমান। এরপর এক বছরেই প্রতিষ্ঠানটি টিকিট বিক্রির ৩৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। নিরীক্ষাকালে এই ট্রাভেল এজেন্টকে বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগের কোনো নথি বিমানের কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। একইভাবে লন্ডনে বিমানের বিক্রয় এজেন্ট কেএমসি ট্রাভেল টিকিট বিক্রির ৩১ হাজার ৬৮০ পাউন্ড (৪১ লাখ ১৫ হাজার টাকা) আত্মসাৎ করেছে। একই বছর সৌদি আরবে সাব-এজেন্ট টিকিট বিক্রির প্রায় ৩ কোটি টাকা জমা দেয়নি। টিকিট বিক্রির এসব টাকা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য ওই সব দেশে তখন কর্মরত বিমানের কান্ট্রি ব্যবস্থাপক ও অর্থ ব্যবস্থাপকদের দায়ী করা হয়েছে। কাঠমান্ডুর চার বিক্রয় এজেন্টের কাছে ৪৩ লাখ নেপালি রুপি ২০০৯ সাল থেকে বকেয়া রয়েছে। সেই পাওনা আদায় না করে ২০১২ সালে এর চেয়ে বেশি অর্থ এজেন্টদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। পাওনা অর্থ সমন্বয়ের যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও তা না করে সেলস এজেন্টকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে বিমানের আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। বহর পরিকল্পনার বাইরে একটি উড়োজাহাজ ভাড়ায় (ওয়েট লিজ) এনে এক বছর পরিচালনা করে ১৭৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ক্ষতি করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়। এ ক্ষতির বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করে বলা হয়, এ বিষয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। বিমানযাত্রীদের টিকিট বিক্রি হতে আবগারি শুল্ক ও ভ্রমণ কর আদায় করা হলেও সরকারি কোষাগারে ৩৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা কম জমা দেওয়া হয়, যা নিরীক্ষায় ধরা পড়েছে। আশুলিয়ায় অবস্থিত বিমানের পোলট্রি কমপ্লেক্সে ২০১১-১২ অর্থবছরে মুরগির মাংস নির্ধারিত হারের চেয়ে ১ লাখ ৪০০ কেজি কম হিসাবভুক্ত করে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা সন্তোষজনক নয় বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ব্যাখ্যাসহ উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর বিমানের দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে পরিত্রাণের উপায় ঠিক করার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি উপকমিটি করে। মঈন উদ্দীন খান বাদলের নেতৃত্বে উপকমিটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে বিষদ প্রতিবেদন জমা দেয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিমানের দুর্নীতি হয়, এমন খাতগুলো আমরা চিহ্নিত করেছিলাম। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে দুর্নীতির ধারা অব্যাহত রয়েছে।’ তিনি বলেন, আজকে বিভিন্ন নিরীক্ষায় ও তদন্তে দুর্নীতির যেসব কথা আসছে, এগুলো একেবারে স্বাভাবিক। কারণ, বিমানে দুর্নীতির মাধ্যমে যে পুকুরচুরি হয়, তা বন্ধে সামান্যতম পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি।

No comments:

Post a Comment