বছরজুড়েই বিনিয়োগ মন্দা, উদ্বৃত্ত তারল্য, রেমিট্যান্সের অর্থ বাকিতে বিক্রি, সর্বোপরি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতির কারণে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বৈদেশিক বাণিজ্য কমে যাওয়া, স্থানীয় আয়ের উৎসও সঙ্কোচিত হওয়ার পাশাপাশি খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সার্বক্ষণিকই আদায় বাড়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকত
ে হচ্ছে। এর পরেও জোড়াতালি দিয়ে অনেককেই লোকসান সমন্বয় করতে দেখা গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বছরের শেষ মুহূর্তেও লোকসান সমন্বয় করার চেষ্টা চলছে। বিকল্প পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ কমানো হচ্ছে। ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই খেলাপি ঋণ নবায়ন, কেউ ডাউন পেমেন্ট না দিলে বিধিবহির্ভূতভাবে চেক গ্রহণ, ঋণ অবলোপন, ঋণ মঞ্জুরির তারিখ পরিবর্তন করার মতো ন্যক্কারজনক কাজ করার অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। কোনো কোনো ব্যাংক থেকে যেকোনো উপায়ে খেলাপি ঋণ কমাতে ইতোমধ্যে শাখা ব্যবস্থাপকদের নির্দেশও দেয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতের এমন অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ এতে ব্যাংকিং খাতে জলিয়াতি চক্রদের উৎসাহিত করা হবে, ব্যাংকের ওপর জনগণের আস্থা কমে যাবে। এমনকি বহির্বিশ্বেও দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর ভাবমর্যাদা ুণœ হবে, যা প্রতি পদে পদে আমাদের খেসারত দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে ঋণ অবলোপন করা কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়। কেননা, এতে এত দিন যারা ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতির মাধ্যমে জনগণের অর্থ বের করে নিচ্ছে তারা পার পেয়ে যাবে। ফলে অন্যরাও জালিয়াতিতে উৎসাহিত হবে। তিনি বলেন, ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমেই ঋণ নবায়ন করতে হবে। এর বাইরে কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করলে ব্যাংকিং খাতে শুধু কাগজে আদায়ই বাড়বে। প্রকৃতপক্ষে ঋণ আদায় বাড়বে না। এর ফলে ব্যাংকিং খাতের ওপর থেকে গ্রাহকদের আস্থা ধীরে ধীরে কমে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে। তিনি বলেন, শুধু স্থানীয়ভাবেই এর প্রভাব পড়বে না, বহির্বিশ্বেও ব্যাংকের ভাবমর্যাদা নষ্ট হবে। তিনি বলেন, এসব অনিয়ম প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো শক্ত অবস্থান নিতে হবে। তদারকি বাড়াতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ আদায়ের চাপ দেয়া হচ্ছে। তাদের বলা হয়েছে যেকোনো উপায়ে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, ব্যবসায় বাণিজ্য মন্দার কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে তাদের পক্ষে ঋণ পরিশোধ করাও সম্ভব নয়। তবুও শাখা ব্যবস্থাপকদের চাপ দেয়া হচ্ছে। সার্বক্ষণিক মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চাপে রাখা হচ্ছে। ডিসেম্বরকে সামনে রেখে কোনো ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরই চোখে ঘুম নেই। তারা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেড়াচ্ছেন। সরকারি এক ব্যাংকের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রধান কার্যালয় থেকে ঋণ আদায়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে; কিন্তু ঋণ আদায় বাড়ছে না বরং নতুন করে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ঋণ আদায় কোনো ক্রমেই বাড়ানো সম্ভব হবে না। তবে অপর এক ব্যাংকের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিকল্প পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ব্যাংক থেকে শাখা ব্যবস্থাপককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে শাখা ব্যবস্থাপকদের ঋণ আদায় বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ১৯ নভেম্বর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে এক সভার সিদ্ধান্ত গত ২৬ নভেম্বর সব শাখা ব্যবস্থাপককে চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ডিসেম্বরে নতুন করে কোনো ঋণ শ্রেণীকৃত হতে দেয়া যাবে না। প্রত্যেক শাখাকে কমপে ৩৫ শতাংশ শ্রেণীকৃত ঋণ কমাতে হবে। এটা না পারলেও নতুন করে কোনো ঋণ শ্রেণীকৃত হয়ে গেলে শাখা ব্যবস্থাপক দায়িত্ব পালনে সচেতন নন মর্মে চিহ্নিত হবেন। নতুন করে কেউ শ্রেণীকৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তা রোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ঋণ নবায়নের েেত্র যেসব গ্রহীতা এ মুহূর্তে প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট দিতে পারবেন না, তাদের থেকে চেক গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া অবলোপনযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও যেসব ঋণ অবলোপন করা হয়নি, সেগুলোর ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে যেকোনো মূল্যে খেলাপি ঋণ ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার কোটিতে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত জুনের চেয়ে সেপ্টেম্বরে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯০ কোটি টাকা। জুনে যেখানে খেলাপি ঋণ ছিল তিন হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে চার হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংকটির বড় খেলাপি ঋণও তড়িঘড়ি করে অবলোপন করার চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। ব্যাংকারদের মতে, ব্যবসায় বাণিজ্য মন্দার কারণে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ছে না, বরং খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এর ফলে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে বর্ধিত হারে। বছরজুড়েই এ অবস্থা ছিল। বিনিয়োগ মন্দার কারণে প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল। ব্যাংকগুলো এ উদ্বৃত্ত তারল্য কমাতে আমানতের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে এনেছে। একই কারণে ব্যাংক আহরিত বৈদেশিক মুদ্রারও চাহিদা কম ছিল। ব্যাংকগুলো নগদ টাকা দিয়ে রেমিট্যান্স আহরণ করলেও চাহিদা না থাকায় বাকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। সব মিলে ব্যাংকের মুনাফা কাক্সিত হারে হয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরের আগে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়নের সুযোগ দিয়েছিল। ফলে ওই সময় প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি প্রভিশন করতে হয় কম পরিমাণে। যার ফলে গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকের জোড়াতালি দিয়ে মুনাফা বেড়েছিল; কিন্তু এবারের ভিন্ন চিত্র। গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এর চিত্র ফুটে ওঠে। ব্যাংকের বেশির ভাগ আয়ই চলে যায় প্রভিশন সংরক্ষণে। তাই ডিসেম্বর প্রান্তিকে বিকল্প পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। গতবারের মতো এবারো ব্যাংকের লোকসান সমন্বয় করে মুনাফায় ফিরে আসার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment