ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে আনা ভয়াবহ সুনামির দশকপূর্তি হয়েছে গতকাল শুক্রবার। ওই প্রলয়ংকরী দুর্যোগ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন এবং প্রাণ হারানো দুই লাখ ২০ হাজার মানুষের স্বজনেরা বিভিন্ন স্থানে সমবেত হয়ে শোক পালন করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত হয় প্রার্থনা। খবর রয়টার্স, এএফপি ও বিবিসির। এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন উপকূল এবং আফ্রিকার উপকূলের বেশ কয়েকটি স্থা
নে ২০০৪ সালে ২৬ ডিসেম্বর ওই সুনামি (ভূমিকম্পজনিত সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস) আঘাত হেনেছিল। ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম প্রান্তে ৯ দশমিক ৩ মাত্রার প্রচণ্ড ভূমিকম্পই ছিল এর কারণ। এর প্রভাবে একের পর এক সুবিশাল সামুদ্রিক ঢেউ ১৪টি দেশের উপকূলে আঘাত হানে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকা উপকূলের দেশ সোমালিয়া। নিহত মানুষের মধ্যে অনেকেই ছিল বড়দিন উদ্যাপনরত বিদেশি পর্যটক। মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, কেনিয়া ও তানজানিয়াও ওই সুনামিতে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আচেহ প্রদেশের বান্দা আচেহ শহরে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় গতকালের স্মরণানুষ্ঠান। ভাইস প্রেসিডেন্ট জুসুফ কালা ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি ওই এলাকায় সুনামির সময় ১১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু ঢেউ আঘাত হেনেছিল। স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদেও গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। সুনামিতে ইন্দোনেশিয়ায় মৃতের মোট সংখ্যা ছিল এক লাখ ৭০ হাজার। থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে মোট পাঁচ হাজার ৩০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল। তাদের মধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধেক। সেখানকার জেলেদের গ্রাম বান নাম খেমে আয়োজন করা হয় এক স্মরণ অনুষ্ঠানের। ওই গ্রামের প্রায় তিন হাজার মানুষের খোঁজ মেলেনি। থাইল্যান্ডে হতাহত মানুষের ৮০ শতাংশই ছিল ফ্যাং ন্গা প্রদেশের। সেখানে ৩৯টি দেশ থেকে বিশেষজ্ঞরা গিয়েছিলেন লাশ শনাক্ত করার কাজে। এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফরেনসিক তদন্তের ঘটনা। সুনামিতে সুইডেনের ৫৪৩ জন পর্যটক প্রাণ হারিয়েছিল। তাদের স্মরণে দেশটির উপসালা ক্যাথেড্রালে গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বজনদের পাশাপাশি রাজপরিবারের সদস্যরাও যোগ দেন। শ্রীলঙ্কায় মৃত্যু হয়েছিল ৩১ হাজার মানুষের। সেখানে যাত্রীবাহী একটি ট্রেনে সুনামির আঘাতে প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। রাজধানী কলম্বোয় গতকাল ওই বিপর্যয়ের দশকপূর্তিতে স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় তামিলনাড়ু রাজ্যে প্রাণ হারায় প্রায় ছয় হাজার মানুষ। আকস্মিক ওই দুর্যোগে আক্রান্ত দেশগুলোয় উদ্ধার তৎপরতা চালানো এবং ত্রাণ সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তবে পরবর্তী কয়েক মাস ধরে সারা বিশ্ব থেকে অন্তত এক হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলারের আর্থিক সহায়তায় বিপর্যয়-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়। ভয়াবহ ওই দুর্যোগের পর সুনামি সতর্কতা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। ভারতের প্রত্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের দুর্যোগের পূর্বাভাস জানানোর একটি নতুন প্রযুক্তি চালু করার চেষ্টা করা হলেও তা বেশি দূর এগোয়নি। থাইল্যান্ডের দুর্যোগ সতর্কতাকেন্দ্র বলছে, তাদের কাছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকলেও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের সুযোগ সীমিত। ২০১১ সালে ভারত মহাসাগরজুড়ে একটি সুনামি সতর্কতা ব্যবস্থা চালু করা হয়। এটি সমুদ্রের পানির বিভিন্ন পরিমাপ, ভাসমান বস্তু বা বয়া এবং ভূমিকম্প পর্যবেক্ষক যন্ত্রের সমন্বয়ে তৈরি একটি যোগাযোগব্যবস্থা। পাশাপাশি কয়েকটি দেশও দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতির লক্ষ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে। এ খাতে গত এক দশকে উপকূলীয় ২৮টি দেশ মোট ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। তবে ১০ বছর আগের সেই সুনামির ভয়াবহতা ভুলে যাওয়ার ফলে নতুন কোনো দুর্যোগে আবারও একই ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, উপকূলীয় লাখ লাখ গ্রাম এখনো অরক্ষিত রয়েছে।
No comments:
Post a Comment