শীতে ও কুয়াশায় বিপর্যস্ত দেশ। সূর্য ছিল সারা দিন কুয়াশায় ঢাকা। অনেক স্থানে সারা দিনেও সূর্যের দেখা মিলছে না। শিশুদের পাশাপাশি বৃদ্ধরাও শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রচণ্ড শীতে নওগাঁয় মুক্তিযোদ্ধা শামসুল ইসলামের (৫৭) মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। ঘন কুয়াশায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। ঝুঁকিপূর্ণ বলে রাতে যান চলাচলও কম। ফেরি ও লঞ্চের যাত্রা প্রতিদিনই বিলম্ব হচ্ছে। ঘন কুয়াশায় বিমান চলাচলেও ব
িঘœ ঘটছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আগামী পাঁচ দিনে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাতের তাপমাত্রা কমে যেতে পারে ধীরে ধীরে। ফলে এর মধ্যে ঘন কুয়াশার পরিমাণও কমবে না। বিশেষ করে দেশের নদী, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ের তীরবর্তী এলাকা ভারী কুয়াশায় ঢাকা থাকবে। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উপমহাদেশীয় উচ্চ চাপ বলয়ের একটি বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর আশপাশের বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে বলে শীত পড়েছে। উচ্চ চাপ বলয় বয়ে নিয়ে আসে হিমশীতল ঠাণ্ডা হাওয়া। এই হাওয়া সাধারণত ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো কোনো সময় এটি আরো নিচে নেমে গেলে ঠাণ্ডার মাত্রা বাড়ে। মূলত উপমহাদেশীয় উচ্চ চাপ বলয় ভারতের বিহার রাজ্য বরাবর পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ এবং সেই সাথে যশোর অঞ্চলকে ছুঁয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করছে। ফলে এ অঞ্চলগুলোতে প্রচণ্ড শীত পড়েছে। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ঈশ্বরদীতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকা বিভাগের মধ্যে ঢাকাতেই তাপমাত্রা কিছু বেশি ছিল। ঢাকা বিভাগের অন্যান্য অঞ্চলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ছিল। শীতের মাত্রা আরো বেশি অনুভূত হওয়ার আরো একটি কারণ হলো সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যে ব্যবধান কমে গেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ ছাড়া অবশিষ্ট পাঁচ বিভাগের বেশির ভাগ অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল না। আবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। এর সাথে আবার গতকাল দিনের বেশির ভাগ সময় সূর্যের দেখা মিলেনি। সূর্যালোক না থাকাও শীতের মাত্রা বেশি অনুভূত হওয়ার আরো একটি কারণ। আবার কুয়াশা থাকায় ভূ-উপরিতলের তাপমাত্রা দ্রুত শোষিত হয়ে যাচ্ছে। শীতের মাত্রা কমে বেশি অনুভূত হওয়ার এটিও আরেকটি কারণ। শীতের শুরুতেই শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে শীতজনিত সর্দি, কাশি, জ্বর, হাঁপানির প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এই রোগগুলোর ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: আতিয়ার রহমান বলেন, শীত শুরু হলেই যারা এসব রোগে ভুগে থাকেন তাদের ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলা উচিত। গরম পানি পান করা উচিত। শুরুতেই গরম পানি পান করা হলে কাশি, হাঁপানিতে উপকার পাওয়া যাবে। গোসল করতে হবে গরম পানি দিয়ে। গলায় গরম লাগে এমন কাপড় অথবা মাফলার পেঁচিয়ে রাখতে হবে। এটি করা হলে ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রকোপ থেকে অনেকটা রেহাই পাওয়া যাবে। এ ছাড়া রোগের প্রকোপ বেশি হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। নওগাঁ সংবাদদাতা জানান, জেলায় শীতে শামসুল ইসলাম (৫৭) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। গতকাল ভোর সাড়ে ৩টায় বগুড়ার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি জেলার মহাদেবপুর উপজেলার উত্তরগ্রাম এলাকার বাসিন্দা। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে বগুড়ার ঠনঠনিয়ায় ভাড়া বাসায় রাত ১টার দিকে প্রচণ্ড শীতে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর তার শরীর ঘেমে অসুস্থ হয়ে পড়লে সাথে সাথে তাকে বগুড়া ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে রাত সাড়ে ৩টার দিকে তিনি মারা যান। শামসুল ইসলাম পরিবহন কোম্পানি হানিফ এন্টারপ্রাইজের উত্তরাঞ্চলের ম্যানেজার ছিলেন। গতকাল শুক্রবার বিকেলে উত্তরগ্রাম পারিবারিক গোরস্থানে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছ। লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ঢাকা-মাওয়া-খুলনা মহাসড়কের শিমুলিয়া-কাওরাকান্দি নৌরুটের শিমুলিয়া ফেরিঘাটে গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনেও তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। সপ্তাহব্যাপী ঘন কুয়াশার কারণে নৌরুটে ফেরি চলাচলে অচলাবস্থা দেখা দেয়ায় ফেরিঘাটে দুই তিন দিন আগে আসা শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক গতকালও পারপার হতে পারেনি। ফলে সকাল থেকে আড়াই শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক ও তিন শতাধিক যাত্রীবাহী বাস ও ছোট গাড়িসহ সাড়ে পাঁচ শতাধিক যানবাহন ফেরি পারারের অপেক্ষায় থাকতে হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। ফেরি কর্তৃপক্ষ বিকেল ৩টায় যানবাহনের চাপ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও এ সময় দুই শতাধিক ট্রাক ও অর্র্ধশতাধিক যাত্রীবাহী হালকা যানবাহন ও বাস ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় ছিল। মাওয়া বিআইডব্লিউটিসির ম্যানেজার বাণিজ্য শেখর চন্দ্র রায় বিকেল ৩টায় জানান, যানবাহনের বেশি চাপ এবং কুয়াশার কারণে দুই-তিন দিনের ট্রাক আটকে থাকায় এখনো ফেরিঘাটে আড়াই শতাধিক ট্রাক ও অর্ধশতাধিক যাত্রীবাহী যানবাহন ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের সার্র্জেন্ট সাহাদত জানান, গত কয়েক দিন ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় ফেরিঘাটে সে ধকল এখনো কাটেনি। কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। সন্ধ্যা নামার আগেই ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে গোটা জনপদ। বৃষ্টির মতো পড়ছে কুয়াশা। দিনভর সূর্যের দেখা না মেলায় বিপাকে পড়েছে মানুষজন। শীতের সাথে হিমেল হাওয়ায় নদী-তীরবর্তী এলাকার মানুষজন গরম কাপড়ের অভাবে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র তীরের আসমা বেগম জানান, আমার গরম কাপড় নেই। কেউ কম্বল সাহায্যও দেয়নি। যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, আমার এলাকায় এবার শীতার্ত মানুষের জন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে কম্বল ও সাহায্য পাওয়া যায়নি। এ দিকে শীতার্ত মানুষের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে আট হাজার কম্বল বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল। জেলা প্রশাসক এ বি এম আজাদ জানান, শীতার্তদের জন্য আরো ১০ হাজার কম্বলের বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ আতিকুর রহমান জানান, কুড়িগ্রাম অঞ্চলের তাপমাত্রা ১৪ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে ডায়েরিয়া, নিউমোনিয়াসহ নানা শীতজনিত নানা রোগে। ঝালকাঠি সংবাদদাতা জানান, ঘন কুয়াশায় এবং কনকনে শীতে ঝালকাঠিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সারা দিনেও সূর্যের মুখ দেখা যায় না। ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সড়ক ও নৌযানগুলো অনেক দেরিতে পৌঁছাচ্ছে। কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা কমে আসায় নৌযানগুলো চড়ায় আটকে যাচ্ছে। প্রচণ্ড শীতে অসহায় হয়ে পড়েছে দিনমজুরেরা। শীতের কারণে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশির ভাগ শিশু ও বয়স্ক ভর্তি হচ্ছে। ইসলামপুর (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, কয়েক দিনের ঘনকুয়াশা ও তীব্র শীতে ইসলামপুরের যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী অববাহিকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত শনিবার থেকে টানা পাঁচ দিনের ঘনকুয়াশা ও তীব্র ঠাণ্ডায় শ্রমজীবী মানুষ ঘরের বাইরে বের হতে না পারায় চরম সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। তীব্র শীত ও ঠাণ্ডায় শিশু-বৃদ্ধদের মধ্যে ঠাণ্ডাজনিত রোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসূমুর রহমান বলেন, চর জীবিকায়ন প্রকল্প থেকে এক হাজার ৫০০ কম্বল ও দুর্যোগ-ত্রাণ শাখার এক হাজার ১০০ কম্বল ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনা অল্প। নোয়াখালী সংবাদদাতা জানান, নোয়াখালীর নয়টি উপজেলার শৈত্যপ্রবাহে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। গত দুই দিন ধরে জেলার নয়টি উপজেলার সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি সর্বক্ষণ কনকনে হিমেল হাওয়া বইছে। সন্ধ্যার পর পর ঘন কুয়াশায় অন্ধকার হয়ে পড়ে পথঘাট। প্রচণ্ড শীতে গরিব অসহায় মানুষের চরম দুর্ভোগের অন্ত নেই। ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জানান, ফুলবাড়ীতে জেঁকে বসেছে শীত। গত তিন দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। ফুলবাড়ী হাসপাতালে বেড়েছে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর ভিড়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, গত দুই দিনে প্রায় শতাধিক রোগী ঠাণ্ডাজনিত রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন। শীতে বিপাকে পড়েছেন নি¤œ আয়ের মানুষ। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনিরুজ্জামান ও উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্য খুরশিদ আলম মতি বলেন, এখনো সরকারিভাবে শীতবস্ত্র বরাদ্দ আসেনি, তবে তারা ব্যক্তিগতভাবে শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র দিয়েছেন। সরকারি বরাদ্দ পাওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপরে সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে তারা জানান।
No comments:
Post a Comment