Monday, December 29, 2014

বৈশ্বিক ১৪ নির্বাচনে জয়:কালের কন্ঠ

বাংলাদেশ গত এক বছরে প্রায় ১৪টি আন্তর্জাতিক ফোরামের সব নির্বাচনে জয় পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পর সর্বোচ্চ ফোরাম মানবাধিকার
কাউন্সিলের সদস্য পদে জয়। এ ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্রের দুই বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে ভোটের লড়াইয়ে জয় এসেছে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী গত ৯ অক্টোবর কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) চেয়ারপারসন এবং গত ১৬ অক্টোবর আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডসভিত্তিক স্থায়ী সালিসি ট্রাইব্যুনালেও এ বছর বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। ওই রায়ে নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার, বিশাল সাগর এলাকা। কূটনৈতিক অঙ্গনে ঢাকার ২০১৪ সালটি শুরু হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনা আর উদ্বেগ নিয়ে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর নির্বাচনের পর সমালোচনায় মুখর ছিল পশ্চিমা দেশগুলো। বছর শেষে সেই দেশগুলো নির্বাচন ইস্যুতে আগের অবস্থানেই রয়েছে। তবে আগের মতো সরব নয়। তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করছে, সমস্যার সমাধান করতে হবে এ দেশের মানুষকেই। দৃশ্যত সারা বছর নানামুখী তৎপরতায় সমালোচনার চাপ সামলেছে সরকার। একই সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্কে এসেছে নতুন মাত্রা। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, পশ্চিমাদের চোখে 'একতরফা' ও 'অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ' ওই নির্বাচনের পরও বৈদেশিক সম্পর্কে দৃশ্যমান প্রভাব না পড়া বা সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত থাকাটা গত এক বছরে বাংলাদেশের বড় কূটনৈতিক সাফল্য। বিদেশের সঙ্গে সম্পর্কটা নির্বাচন ইস্যুতে আটকে থাকেনি। এর অন্যতম কারণ নির্বাচনের আগের দিনগুলোর চেয়ে পরে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। তবে নতুন বছরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে বিদেশিদের উদ্বেগ মোকাবিলা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচনের পর প্রথম অভিনন্দন বার্তাটি আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগ সত্ত্বেও ভারত ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানকে স্বাগত জানায়। বছরের মাঝামাঝি ভারতে ইউপিএ সরকারের বিদায়ের পর ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার নিয়ে দৃশ্যত উদ্বিগ্ন ছিল বাংলাদেশ। তবে সেই শঙ্কা ইতিমধ্যে দূর হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিকবার বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গড়েছেন। আর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ বাঁচিয়েছেন।' গত জুন মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর ছিল সরকারের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও স্বস্তির। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দিল্লি সফর করেন এবং দুই দেশের মধ্যে যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ইতিমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দুই দফা বৈঠক হয়েছে। প্রতিটি বৈঠকেই নরেন্দ্র মোদি স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরে জোর প্রয়াস চালানোর কথা জানিয়েছেন। মোদি সরকার ইতিমধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বিল ভারতের সংসদে উপস্থাপন করেছে। আগামী দিনগুলোতে এ ইস্যুটির সফল নিষ্পত্তি হবে বলে উভয় দেশ আশা করছে। যুক্তরাষ্ট্র গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ জানালেও বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জোরালো, গভীর ও বিস্তৃত বলে মন্তব্য করেছে। গত অক্টোবর মাসে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত দুই দেশের সব ইস্যুতে আলোচনার সর্বোচ্চ ফোরাম অংশীদারি সংলাপকে অত্যন্ত সফল বলে মনে করছে বাংলাদেশ। ওই সংলাপ শেষে ঘোষিত যৌথ বিবৃতিতে 'গণতন্ত্র' ও 'নির্বাচন' না থাকাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দ্বিপক্ষীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত যৌথ ঘোষণায় স্থান পাওয়াও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল গত নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরকালে 'অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের' তাগিদ দিয়েছেন। তবে ওই সফরের সময়ই নিশা বিসওয়াল ও যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার বিরূপ মন্তব্য কূটনৈতিক মহলের দৃষ্টি কাড়ে। এ বছর মিয়ানমারের সঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে এ দেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত ওই দেশটির নাগরিক ও শরণার্থীদের (রোহিঙ্গা) ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খানের মন্তব্যকে ঘিরে ঢাকায় সে দেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। গত নভেম্বর মাসে কাঠমাণ্ডুতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পথে মাইলফলক। বর্তমান সরকারের মেয়াদে গত মার্চ মাসে প্রথম বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ অতিথি হিসেবে ঢাকা সফরে আসেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিসিদা। আট বছর পর এটিই ছিল জাপানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম ঢাকা সফর। এরপর মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরে যান। বড় ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা সফরে আসেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করেন। বছরের শেষ সপ্তাহে ঢাকা সফর করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং আই। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফর করতে পারেন। গত জুন মাসে প্রথমবারের মতো ঢাকা সফর করেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে। প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে মিয়ানমার, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ইতালি, মালয়েশিয়া ও নেপাল সফর করেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ চীন, ইউএই, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, সিঙ্গাপুর ও বলিভিয়া সফরে যান। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, আঞ্চলিক যোগাযোগ (কানেক্টিভিটি) বৃদ্ধির কূটনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডর ইস্যুতে বাংলাদেশে বৈঠক হয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে তাঁর ঢাকা সফরে বিগ-বি গ্রোথ বেল্টের সম্ভাবনার কথা বলেছেন। নেপালে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার আঠারোতম শীর্ষ সম্মেলন শেষে কাঠমাণ্ডু ঘোষণায় বাংলাদেশের বেশ কটি অগ্রাধিকার প্রাধান্য পেয়েছে। অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার ইস্যুতেও বাংলাদেশ সোচ্চার ছিল। আর নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার সমর্থন মিলেছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সে সংসদ নির্বাচনকে বিতর্কের মুখে ঠেলে দেওয়ার অনেক অপচেষ্টা করা হয়েছে, সেই সংসদের স্পিকার ও একজন সংসদ সদস্য সিপিএ ও আইপিইউএর সর্বোচ্চ পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এ নির্বাচন করতে গিয়ে ভোট চাওয়ার সময় আমরা বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছি। বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলো ও ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সিপিএ নির্বাচনের মাধ্যমে কমনওয়েলথে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা আরো কয়েক ধাপ এগিয়েছে।' ইতিহাস গড়েছে জাতীয় সংসদ : বিদায়ী বছরে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। দশম জাতীয় সংসদের দুই প্রতিনিধি বিশ্বের সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দুটি বৃহত্তর ফোরামের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। দেশের বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক জোট বাইরে থাকলেও এই সংসদ অতীতের নেতিবাচক রেকর্ড ভঙ্গ করে ইতিবাচক রেকর্ড গড়েছে। সংসদ অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করলেও বিরোধী দল এক দিনের জন্যও সংসদ বর্জন করেনি। বিএনপি-জামায়াত জোটের দাবি উপেক্ষা করে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরপর ১২ জানুয়ারি বিজয়ী সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকারি দলের আসনে বসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট। সংসদ নেতা পুনর্নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক সময়ের স্বৈরশাসক এরশাদের দল জাতীয় পার্টি আগের মতো সরকারে থাকলেও সংসদে তারা বসে বিরোধী দলের আসনে। আর জাপার সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। সংসদ নেতার ছেড়ে দেওয়া রংপুরের পীরগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী দশম সংসদের স্পিকার পুনর্নির্বাচিত হন। আর গাইবান্ধা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। এই সংসদে সর্বোচ্চ রেকর্ডসংখ্যক ১৬ জন স্বতন্ত্র সদস্য রয়েছেন।    

No comments:

Post a Comment