Monday, December 29, 2014

ফের সর্বনাশা হরতাল আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা:কালের কন্ঠ

২০১৩ সালের হরতাল-অবরোধে সর্বনাশের ক্ষত এখনো শুকায়নি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বছরখানেক গেছে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। এই স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ক্ষতি পোষানোর চে
ষ্টা ছিল ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এই সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়সহ দু-একটি ঘটনায় বিচ্ছিন্নভাবে ১৬ দিন হরতাল হলেও তাতে ‘গরম’ হয়ে ওঠেনি দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তাই বড় কোনো আতঙ্ক দানা বাঁধেনি ব্যবসায়ীদের মনে। কিন্তু সরকারের বর্ষপূর্তির মুখে হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে রাজনীতির আঙিনায়। পাশাপাশি ফিরছে অকার্যকর ও সর্বনাশা হরতালও। এর চূড়ান্ত ফল ব্যবসায় স্থবিরতা, লোকসান আর প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হওয়া। এরই মধ্যে আজ ১২ ঘণ্টা হরতাল পালনের ঘোষণা দিয়েছে সংসদের বাইরের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। আর ৫ জানুয়ারি ঘিরে কর্মসূচি পালনের সুযোগ না পেলে আরো তিন দিনের হরতাল ডাকার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। এতে গত বছরের হরতাল-অবরোধের দুঃসহ স্মৃতি আবারও ফিরে আসছে। ফলে আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা হরতালের পথ ছেড়ে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা মেটানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২০১৩ সালে ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক ধস নামে। একের পর এক হরতাল আর অবরোধের দিনগুলোতে কারখানা চালু থাকলেও উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। ফলে দিন কয়েকের মধ্যেই কারখানাগুলোর গুদামঘর ভরে ওঠে। বাধ্য হয়ে মালিকরা বন্ধ রাখেন পণ্য উৎপাদন। অন্যদিকে কারখানা সচল রাখার কাঁচামাল বন্দরেই পড়ে থাকে। ফলে দেশের ভেতরে উৎপাদন-বিপণনের পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানিও স্থবির হয়ে পড়ে। সরকারের রাজস্ব আদায় ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ক্রেতাদের অনেকেই বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। আবার কেউ কেউ ঢাকায় বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকেই ফিরে যান। নারায়ণগঞ্জে গিয়ে পিকেটারদের ইটপাটকেলে আহত হন তৈরি পোশাক কিনতে আসা বিদেশি ক্রেতারা। এমন পরিস্থিতির পর বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোট গত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ব্যবসায়ীদের মনে হরতাল-অবরোধের ‘আগাম আতঙ্ক’ লেগেই ছিল। ফলে ২০১৪ সালজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তেমন না থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে তেমন গতি আসেনি। এ অবস্থার মধ্যেই হরতালের হুঙ্কার ব্যবসায়ীদের আরো আতঙ্কগ্রস্ত করছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, গত নির্বাচনের পর মোট ১৬ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। এর মধ্যে ৪ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন হরতাল চলে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিএনপি প্রথম হরতাল পালন করে ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের কাছে অর্পণ করার প্রতিবাদে। বাকি ১০ দিন হরতাল পালন করেছে জামায়াতে ইসলামী ও বিভিন্ন ইসলামী দল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের প্রতিবাদ, মহানবী (সা.) ও হজ নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করায় আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেপ্তার এবং ইসলামী ফ্রন্টের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কাফেলার উপস্থাপক মাওলানা শায়খ নূরুল ইসলাম ফারুকী খুনের ঘটনায় এক দিন হরতাল হয়েছে। আর বিএনপির গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের মুক্তি এবং গাজীপুরে সমাবেশ করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে আজ হরতাল পালনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যেসব দাবি তুলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হরতাল করছে, সেগুলোর সঙ্গে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আর হরতাল করে অতীতে কোনো দাবি আদায়েরও নজির নেই। রাজনৈতিক দলগুলো কথায় কথায় হরতাল ডেকে মূলত দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বারোটা বাজানো ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারছে না। হরতাল যে দাবি আদায়ের কোনো হাতিয়ার নয়, সে কথা রাজনীতিবিদদেরও অজানা নয়। ক্ষতিকর জেনেও অতীত সরকারগুলো কখনো হরতাল বন্ধে আইনি পথে যায়নি। দলগুলো কোনো বিষয়ে কখনো একমত হতে না পারলেও হরতাল করার অধিকার (!) রক্ষায় তারা সব সময়ই সোচ্চার ও সহমত। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এই ক্ষতিকর কর্মসূচি বন্ধে আইন করার দাবিতে সোচ্চার হয়। ওই সময় সংগঠনটির পক্ষ থেকে তখনকার শেরাটন হোটেলে এক ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়। ওই পার্টিতে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে কখনো হরতাল না করার অঙ্গীকার আদায়ের বহু চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। আবার ২০১২ সালে এফবিসিসিআইয়ের তখনকার সভাপতি এ কে আজাদ ও সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে হরতাল বন্ধে আইন প্রণয়নের দাবি জানান। তাঁর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দুই ব্যবসায়ী নেতা অর্থমন্ত্রীকে প্রস্তাব করেন যাতে দেশের সব গণপরিবহন বীমার আওতায় আনা হয়। এটি হলে হরতালে ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের ভয়ে গাড়ি বন্ধ থাকবে না। প্রস্তাবটিকে অর্থমন্ত্রী তখন জুতসই বলে দাবি করলেও তা কার্যকর করতে কোনো পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর হরতালের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল দাবি আদায় করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের দাবি উপেক্ষা করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নির্বাচন করেছিল। ওই সময় আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন হরতাল করেও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। একইভাবে এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একের পর এক হরতাল করেছে। তাতে দাবি আদায় তো হয়ইনি, উল্টো জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এ জাতীয় হরতাল ডাকা অপ্রয়োজনীয়। জনগণের ভোগান্তি ছাড়া এতে আর কোনো অর্জন হয় না। এখনকার হরতালগুলো শুধু যে জনসমর্থনহীন তা-ই নয়; এই জাতীয় হরতাল শুধু জনভোগান্তি বাড়ায় এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে শিক্ষার্থীদের। স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ থাকে। যার ফলে হরতালে ব্যবসায়ীদের যতটা না ক্ষতি হয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের। গত বছরের ৩ আগস্ট প্রকাশিত ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হরতাল বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট সমস্যা। এর জন্য অনেক দিন ধরেই ধুঁকছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ওই গণমাধ্যমের দেওয়া হিসাব মতে, হরতালের কারণে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের প্রায় ৫৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার (৭০০ কোটি ডলার) ক্ষতি হয়েছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া গত অর্থবছরের সরকারি কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে হরতালে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির তথ্য মতে, হরতালে ১ শতাংশ পুঁজি নষ্ট হলে তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এটি বাংলাদেশের মোট জিডিপির দশমিক ৯ শতাংশ। আর দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের হিসাব মতে, এক দিনের হরতালে দেশের জিডিপির দশমিক ১২ শতাংশ ক্ষতি হয়। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসিবি) হিসাব মতে, এক দিনের হরতালে এক হাজার ৫৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ঢাকা চেম্বারের হিসাবে, এক দিনের হরতালের ক্ষতির এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, হরতালের কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। সাধারণ নাগরিক জীবন, উৎপাদন ব্যবস্থা, পণ্য সরবরাহসহ দৈনন্দিন কার্যক্রম ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থনীতির পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ও শিক্ষা  ব্যবস্থাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে, বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির প্রাক্কালে মুসল্লিদের ঢাকায় আগমন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এফবিসিসিআই জানায়, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল, তা সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কেটে যাচ্ছে এবং অর্থনীতির সব সূচকে ২০১৪ সালে ইতিবাচক ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আবারও হরতাল অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে ভীষণভাবে ব্যাহত করবে। রাজনৈতিক সমস্যাগুলো হরতালের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে কোনোভাবেই সমাধান করা সম্ভব নয়। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, রানা প্লাজা ধস ও রাজনৈতিক অস্তিতিশীলতার পর বিদেশে বাংলাদেশের সুনামহানি ঘটে। ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। ঢাকায় অ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করে বিদেশিদের আস্থা ধরে রাখার চেষ্টার পর আবারও হরতাল ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনবে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আলোচনার টেবিলেই হওয়া উচিত। হরতাল কোনোমতেই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। গেল বছর এমনিতেই তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মন্দাভাব ছিল। এখন ক্রেতারা আসতে শুরু করেছেন, হরতালের কথা শুনলে তাঁরাও ফিরে যাবেন। বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্য যেকোনো দেশে হরতাল ও ধর্মঘট ডাকার প্রবণতা বাংলাদেশের তুলনায় নগণ্য। আগামী যুগে পৃথিবীতে যুদ্ধ কমে যাবে, শুধু হবে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে বসে এমন কর্মসূচি ঠিক করতে হবে, যা জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলবে না, অর্থনীতিরও ক্ষতি করবে না, কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ হবে। হরতাল কেবল পণ্য উৎপাদন ও বিপণনেই ক্ষতি করে না, দেশের আর্থিক খাতের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে উল্লেখ করে এ ধরনের কর্মসূচির বিরোধিতা করেছেন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে দীর্ঘদিন হরতালের কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল, বীমা কম্পানিগুলোও তা থেকে রেহাই পায়নি। দেশের প্রতিটি লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানির প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে। নন-লাইফ ইনস্যুরেন্স ব্যবসার প্রিমিয়াম বাড়ার হারও নগণ্য। দেশের চলমান সংকট উত্তরণে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত যুক্তি ও নিয়মের মধ্যে থেকে হরতাল পরিত্যাগ করে নিজস্ব কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া।

No comments:

Post a Comment