Sunday, December 21, 2014

দুর্নীতির লাগাম টানতে তৃণমূলে যাচ্ছে সরকার:কালের কন্ঠ

দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা বুঝতে এখন আর টিআইবির ধারণা সূচকের প্রসঙ্গ টানার দরকার হয় না। সরকারি সেবার সঙ্গে ঘুষের যোগ স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষও আর এ নিয়ে
উচ্চবাচ্য করে না। অনেক সময় শুধু ঘুষে পার পাওয়ারও জো নেই। সঙ্গে থাকে হয়রানি, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। যে সেবা বিনা মূল্যে বা নির্ধারিত ফি দিয়ে পাওয়ার কথা, অনেক অর্থ খরচ করেও দিনের পর দিন তার জন্য ঘুরতে হয়। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য গ্রাম-গঞ্জ-উপশহর-শহরে যেসব সরকারি স্থাপনা আছে, কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, হেনস্তা হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই তাঁদের কাছে যান সাধারণ মানুষ জন্ম-মৃত্যু সনদ থেকে শুরু করে ভিজিডি বা বয়স্ক ভাতা কার্ড, জমির নামজারি, থানায় সাধারণ ডায়েরির মতো জরুরি কাজ সারতে। হয়রানির জন্য সরকারি অফিসের লোকদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সাধারণ মানুষের অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যকর নয়। সাধারণের এসব কষ্টের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর দায়িত্বশীল কারো চোখে যদি পড়ে, তাহলেই হয়তো কখনো কখনো কিছু প্রতিকার মেলে। অনেক সময় ফল হয় উল্টোও। তবে তৃণমূলে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে শেকড় গেড়ে বসা এ নৈরাজ্য নিরসনে এবার উদ্যোগী হয়েছে সরকার। জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের ভোগান্তির কথা শুনতে সপ্তাহের একটি দিন ঠিক করতে। জেলা প্রশাসক সরাসরি ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শুনবেন, হয়রানি দূর করতে সংশ্লিষ্টদের তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেবেন বা ব্যবস্থা নেবেন। সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছে। 'গ্রিভেন্স রিড্রেস মেকানিজম' বা ক্ষোভ নিরসন পদ্ধতির চর্চা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে বলে জানালেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা। তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে তাঁর কার্যালয়ে বসে কালের কণ্ঠের কাছে ব্যাখ্যা করলেন সরকারের এ উদ্যোগের লক্ষ্য। তিনি জানিয়েছেন, সমস্যার পিছু নিয়ে তৃণমূলে যাচ্ছে সরকার। শুধু বড়গুলো নয়, ছোট ছোট দুর্নীতি বা হয়রানির বিষয়গুলোতেও সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চায়। ছোট একটা নামজারির জন্য সাধারণ মানুষকে পড়তে হচ্ছে সীমাহীন দুর্দশায়। একটি ফরমের জন্য এ টেবিল ও টেবিল ছুটে বেড়াতে হয়। সমস্যাসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জমা দিলেও পরের সপ্তাহে আবার নতুন করে দিতে হয়। সামান্য তথ্যের গরমিলের জন্য এই ভোগান্তি। এ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতেই সরকার সমস্যার পিছু নিয়ে যাবে সাধারণ মানুষের দরজায়। সে কাজ শুরুও হয়ে গেছে। প্রতিটি ডিসি অফিসে হচ্ছে গণশুনানি। সেখান থেকে এ শুনানি পৌঁছে যাবে উপজেলায়, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদেও। পর্যায়ক্রমে তা ছড়িয়ে দেওয়া হবে সব সরকারি অফিসে। জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে যশোর জেলার তিন উপজেলায় গণশুনানি হবে। এখানেই শেষ নয়। শুনানি থেকে পাওয়া সমস্যার কী সমাধান দেওয়া হয়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করা হবে কেন্দ্রে বসে। পাশাপাশি বড় বড় দুর্নীতি মোকাবিলায় গাইডলাইন করা হচ্ছে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলকে। আগে বিধিবিধানের জন্য অনেক কিছু করা যেত না। সেসব পাল্টে ফেলার জন্য বদলানো হয়েছে সচিবালয় নির্দেশমালাও। এর মাধ্যমে সেবা প্রদানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও তা রক্ষার সংস্কৃৃতি গড়ে তোলা, সেবা দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করা, নাগরিক মতামত ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। সরকারের সব পর্যায়ে ইনোভেশন টিম গঠন করা হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিশেষায়িত জ্ঞান চর্চায় উৎসাহ দিতে থিমেটিক গ্রুপ গঠন করা হচ্ছে। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও পরীবিক্ষণ চলছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম সমন্বয় করা হচ্ছে। আর যাদের জন্য এসব চেষ্টা, সেই সাধারণ মানুষের পরিসংখ্যান থাকছে সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসে। জনগণের জানার সুবিধার্থে চল্লিশটি সরকারি অফিসে কী কী কাজ হয় এর তালিকা ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। সেবাকুঞ্জ নামের এ ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.services.portal.gov.bd। কোন কাজটি কত দিনে শেষ করতে হবে তাও বলে দেওয়া আছে সেখানে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সামনে ঘটা করে এ রকম 'সিটিজেন চার্টার'-এর ফলক তো বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও লাগানো হয়েছিল, তাতে সেবাগ্রহীতার কি কোনো উপকার হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. নজরুল ইসলাম বললেন, এবার সিটিজেন চার্টার ওয়েবসাইটে দিয়ে বা অফিসের দেয়ালে টাঙিয়েই দায়িত্ব শেষ হবে না তাঁদের। এর বাস্তবায়নের বিভিন্ন ধাপও তদারকি করবেন তাঁরা। এ জন্যই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার ইউনিটটি স্থাপিত হয়েছে। অনেক কাজের জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ করতে হয়। জেলা অফিসে গিয়ে বিনা মূল্যের সেই ফরমের জন্য টাকাও গুনতে হয়। সে ঝামেলা থেকে রেহাই দিতে ওয়েবসাইটে হাজারখানেক ফরমও রাখা হয়েছে। এসব উদ্যোগের কারণে ইতিবাচক কিছু সাড়াও মিলছে মাঠপর্যায়ের কোনো কোনো সরকারি অফিস থেকে। সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয় যেসব দপ্তরে, সাব-রেজিস্ট্রারের অফিস এর একটি। সেই সাব-রেজিস্ট্রারদের মধ্য থেকেই প্রস্তাব এসেছে, তাঁরা দলিলের অনুলিপি আগাম ফটোকপি করে রেখে দেবেন যাতে কেউ এসে 'নকল' চাইলে সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যান। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণীত হয়েছে আগেই। এ বিষয়ে মন্ত্রিসভার সম্মতিও মিলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই কৌশলপত্রটির নাম দিয়েছেন 'সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়।' ব্যক্তিপর্যায়ে সেবা প্রদানে হয়রানি কমানোই আপাতত লক্ষ্য এ কৌশলপত্রের, যা এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনে পাঠানো হয়েছে। এটি প্রণয়ন, অনুমোদন ও উপস্থাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মাঠপর্যায়ে দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধের বিষয়ে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করেন মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা। তবে তড়িঘড়ি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে না সরকার। কারণ এতে সুফল পাওয়ার পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ গড়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে। এতে মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে পারে। সে জন্য এখন কৌশলপত্র বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জানানো, সেবা দেওয়া যে তাঁদের দায়িত্ব এবং সেবা পাওয়া যে জনগণের অধিকার তা মনে করিয়ে দেওয়া- প্রাথমিকভাবে এ কাজগুলোই করা হচ্ছে। 'আমরা জোর করে কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। কৌশলপত্রটির আলোকে প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজের মতো করে কর্মপদ্ধতি ঠিক করে নিতে পারবে, যাতে জনগণ সহজে কাঙ্ক্ষিত সেবা পায়', বললেন মন্ত্রিপরিষদসচিব। সরকারের তৈরি এ কৌশলপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। দুর্নীতি দমন কমিশনও একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। ভারতের একটি রাজ্যে সেবা সহজ করার জন্য একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার নাম 'সরকার আপনার দরজায়'। সেখানে গ্যারান্টেড সার্ভিসেস অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছে। এতে সেবা প্রদানের নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রতিদিনের জন্য ২০ রুপি জরিমানা দিতে হয়। তবে বাংলাদেশে এখনই এমন কোনো বিধান করার কথা ভাবছে না মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়। মন্ত্রিপরিষদসচিব বললেন, 'বড় বড় অনেক সংস্কারের উদ্যোগ সফল হয়নি, তাই ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে এগুচ্ছি। আমরা রাতারাতি ফল প্রত্যাশা করি না। তবে ধীরে ধীরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সেবা দেওয়ার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠবে বলে আমাদের বিশ্বাস।' প্রতিবার টিআইবির দুর্নীতি ধারণা সূচক প্রকাশের পর সরকারের পক্ষ থেকে কড়া ভাষায় জবাব দেওয়ার যে রেওয়াজ তা এবার দেখা যায়নি। বরং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দুঃখ করে বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। আশা ছিল দুর্নীতি কমবে। কিন্তু কমেনি, বরং বেড়েছে। দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার চিত্র পাওয়া যায় দুর্নীতি দমন কমিশনের খতিয়ানেও। প্রতিষ্ঠানটিতে গড়ে প্রায় প্রতিদিনই একটি করে বড় অঙ্কের ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির তদন্ত বা মামলা হচ্ছে। সুরাহা না হলেও প্রভাবশালীদের দুদকে এসে হাজিরা দিতে হচ্ছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ের দুর্নীতি ও হয়রানি সর্বব্যাপী, যার প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যাদের ফরিয়াদ জানানোর জায়গা নেই। 'সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়' নামে শুদ্ধাচার কৌশলপত্রটি প্রান্তিক মানুষের প্রাপ্য সেবার মান বাড়াবে- এমনটাই বিশ্বাস কর্মকর্তাদের। মন্ত্রিপরিষদসচিব বললেন, 'রুটি সেঁকার আগে তাওয়া গরম করতে হয়। সেই কাজটাই আমরা শুরু করেছি। আশা করি মাঠপর্যায়ে সেবা প্রদানে পরিবর্তন আসবে।' এসব কাজে সবচেয়ে জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যা সরকারের রয়েছে বলে জানালেন দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক এই কর্মকর্তা।    

No comments:

Post a Comment