Friday, January 30, 2015

রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাড়বে খেলাপি ঋণ:যুগান্তর

দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ায় উদ্যোক্তাদের পুঁজি যেমন আটকে গেছে, তেমনি কমে গেছে তাদের কাছে টাকার প্রবাহ। এই অবস্থায় আর্থিক সংকটে পড়ে অনেকেরই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে যেতে পারে। ফলে ব্যাংকগুলোর অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে। পরে তা খেলাপিতে পরিণত হবে। এই অবস্থায় ব
্যাংকগুলো থেকে এখনই নতুন ঋণ বিতরণে ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যখনই দেশে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে ওই বছরই ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এ কারণে তাদের মুনাফা থেকে প্রভিশন রাখতে হয়েছে বেশি। ফলে বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ পেয়েছেন কম। দুর্বল হয়েছে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি। বাড়তি খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়েছে। ফলে কমেনি ঋণের সুদের হার। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মাঈনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঋণখেলাপি হওয়ার বিষয়টি আংশিক সত্য। এতে পরিস্থিতির কারণে অনেকে খেলাপি হয়। তবে এটিকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী বিশেষ সুবিধা নিতে চায়। অর্থাৎ সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা একটি বড় হাতিয়ার। এই ক্ষেত্রে ব্যাংকের কিছু করার থাকে না। কারণ কিছু ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব : গত চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বছর ২০০৬ সাল জুড়েই ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফলে ওই বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল আড়াই হাজার কোটি টাকা। ২০০৫ সালের শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। ২০০৬ সালের শেষে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২০ হাজার ১০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আক্রান্ত হয়েছে। ফলে ওই বছরও খেলাপি ঋণ বেড়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০০৭ সাল শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। ২০০৮ সালেই বিশ্ব মন্দার প্রভাব কমে আসে। ফলে ওই বছর শেষে খেলাপি ঋণ ১৪০ কোটি টাকা কমে দাঁড়ায় ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকায়। ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই তিন বছর দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় এবং অর্থনৈতিক কোনো মন্দা না থাকায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ সামান্য হারে উঠানামা করেছে। কোনো বড় ধরনের লম্ফঝম্ফ হয়নি। ২০১১ সালে আবার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত হয় দেশ। ওই বছর বিশ্ব বাজারে আমদানি পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় আমদানিকারকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। ফলে তারা ব্যাংকের ঋণ শোধে ব্যর্থ হয়। এতে ওই বছর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়। ২০১১ সালের শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ২০১২ সালের শেষে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। ওই এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২০ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। ২০১৩ সালে বিশ্ব মন্দার প্রভাব কমলেও দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা প্রকট আকার ধারণ করে। এর প্রভাবে ওই খেলাপি আর খুব বেশি কমেনি। ওই বছর শেষে খেলাপি ঋণ ২ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা কমে দাঁড়ায় ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটিতে। ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও অনিশ্চয়তা প্রকট আকার ধারণ করে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণভাবে অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত হয়। এর প্রভাবে বছরের শুরু থেকেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, জুন পর্যন্ত তা বেড়েছে ১০ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এটি চূড়ান্ত হতে পারে। গত বছরও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশংকা করা হয়েছিল। সে আশংকা থেকে বছর শেষে গণহারে খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণ নবায়নের শর্তও শিথিল করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে এই এক মাসে ব্যাংকিং খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ (খেলাপি হওয়ার আগের ধাপ) ঋণের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল ভয়ানকভাবে। ওই এক মাসে দেশের ১৭টি ব্যাংকে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়ে যায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এ কারণে দেশের ১৭টি ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ চিকিৎসা দিয়ে ঋণ আদায় বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে চলতি বছরের শুরু থেকে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। টানা অবরোধের মাসে হরতাল ও সহিংসতার কারণে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমে গেছে। বেড়ে যেতে পারে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঋণ নবায়ন এবং সুদ মওকুফের কিছু আবেদন আসে। কারণ সরকারি ব্যাংকে এলে সবাই ফকির হয়ে যায়। যে পাজেরো গাড়ি নিয়ে আসে তিনিও ফকির, আবার নিুআয়ের মানুষও ফকির। কেউ টাকা দিতে চায় না। এক্ষেত্রে পাজেরো গাড়ি ওয়ালার সুদ মওকুফ করা হলে নিুআয়ের মানুষের টাকা না দেয়াই উচিত। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংক চলতে পারবে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ২০১৩ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় কিছু খাতে প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় এসব খাতে ঋণ নবায়নের আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে কিছু আছে, যৌক্তিক। আর কিছু আবেদনের যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। ফলে আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে ঢালাওভাবে পুনঃতফসিলের নিয়ম করলে অনেকে এই সুবিধা নেবে। ফলে শেষ পর্যন্ত তা সামাল দেয়া যাবে না।  

No comments:

Post a Comment