Friday, January 30, 2015

অবরোধের প্রভাব সারের দামে:যুগান্তর

বোরো ও আলু চাষের ভরা মৌসুম চলছে। দেশব্যাপী সারের চাহিদা তীব্র। কিন্তু টানা অবরোধে সার সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটেছে। ফলে অনেক জায়গায় চাহিদা অনুযায়ী সার পাওয়া যাচ্ছে না। এ সুযোগে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে স্থানীয় পর্যায়ের ডিলাররা সারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বস্তাপ্রতি একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। দাম বৃদ্ধির অসংখ্য অভিযোগও পেয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সার সংকট বা মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষিতে উৎপাদনে নেতিবাচক প্
রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা। টানা অবরোধ আর হরতালে পরিবহন সংকটের কারণে পাবনার নগরবাড়ী ঘাট থেকে উত্তরবঙ্গে সার সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আমদানি করা সার সময়মতো সরবরাহ করতে না পারায় স্থানাভাবে খোলা আকাশের নিচে রাখতে হচ্ছে। এতে সারের গুণগত মান নষ্টের পাশাপাশি বিপাকে পড়ছেন সার আমদানিকারক, শ্রমিকসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) বলছে- সারের কোনো সংকট নেই। দেশব্যাপী চাহিদার তুলনায় বাফার গুদামে বেশি সার মজুদ রয়েছে। অবরোধের দোহাই দিয়ে অসাধু ডিলাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি মুনাফার পাঁয়তারা করছে। বিসিআইসি সূত্র মতে, ধান উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত উত্তরাঞ্চলের রংপুর-রাজশাহীর ১৬ জেলায় মোট সারের চাহিদা ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫৭ টন। বাফার গুদামগুলোতে মজুদ রয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৪৩ টন সার। এ হিসাবে সার সংকটের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে সারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিলাররা ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ বস্তাপ্রতি একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা বেশি নিচ্ছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ডিলাররা অবরোধের অজুহাতে কৃষকদের কাছ থেকে সারের এ বাড়তি মূল্য আদায় করছে। যুগান্তরের রংপুর প্রতিনিধি বলেছেন, সার সংকট তীব্র না হলেও নানা অবরোধের অজুহাতে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়েছেন। এতে বিপাকে পড়েছে চাষীরা। এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না মনিটরিং কমিটি। জানা গেছে, ১৫ দিন আগেও টিএসপির বস্তা ১ হাজার ৫০ টাকায় পাওয়া যেত। এখন তা কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ১৫০ টাকায়। পটাশের বস্তার মূল্য ছিল ৭১০ থেকে ৭২০ টাকা। এখন কিনতে হচ্ছে ৮শ’ থেকে সাড়ে ৮শ’ টাকায়। এছাড়া ৮শ’ টাকার ইউরিয়া সারের বস্তা কিনতে হচ্ছে ৯শ’ থেকে সাড়ে ৯শ’ টাকায়। এ মৌসুমে ইউরিয়া সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। দাম বেশি হওয়ায় প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা ফসল বাঁচাতে বেশি দামে সার কিনে জমিতে প্রয়োগ করছেন। এতে আলু ও বোরো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার আশংকা করছেন কৃষকরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিসিআইসির মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) এম নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সার সংকটের কোনো সুযোগই নেই। দেশে যে পরিমাণ সারের চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি কারখানা ও বাফার গুদামগুলোতে মজুদ রয়েছে। তিনি বলেন, অবরোধে রেল ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় চাহিদা অনুসারে সার সরবরাহ করা হচ্ছে। এজন্য সংকটের কোনো সুযোগ নেই। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, অসাধু ডিলাররা অবরোধের দোহাই দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ পকেটস্থ করছে। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং কমিটির কার্যক্রম জোরদার করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জানা গেছে, দেশব্যাপী মোট সারের চাহিদা হচ্ছে ২৭ লাখ মেট্রিক টন। ২৪ জানুয়ারির হিসাব অনুসারে চাহিদার বিপরীতে দেশব্যাপী ১৫ লাখ ৮৮ হাজার টন সার সরবরাহ করা হয়েছে। বর্তমানে ইউরিয়া সারের মজুদ রয়েছে ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮৩ টন। বাকি সারের বড় অংশ আমদানির জন্য পাইপলাইনে আছে। মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই দেশে পৌঁছবে। এছাড়া দেশের কারখানাগুলোতেও উৎপাদন অব্যাহত আছে। এ পর্যন্ত কৃষকদের চাহিদা অনুসারে যথাযথভাবে সার সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, ৬টি সার কারখানা ও ২৪টি বাফার গুদাম থেকে সারা দেশে সার সরবরাহ করে থাকে সরকার। টানা অবরোধে বিভিন্ন বন্দরে সারের স্তূপ জমা হয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে তা পৌঁছানো যাচ্ছে না। এজন্য স্থানীয় পর্যায়ের ডিলাররা সুযোগ নিচ্ছেন। পাবনা প্রতিনিধি সূত্রে জানা গেছে, টানা অবরোধ আর হরতালে পরিবহন সংকটের কারণে পাবনার নগরবাড়ী ঘাট থেকে উত্তরবঙ্গে সার সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আমদানি করা সার সময়মতো সরবরাহ করতে না পারায় স্থানাভাবে খোলা আকাশের নিচে রাখতে হচ্ছে। সময়মতো এসব সার সরবরাহ করতে না পারলে উত্তরাঞ্চলে আগামী ইরি-বোরো আবাদে বিপর্যয়ের আশংকা করেছেন চাষিরা। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিদিন নগরবাড়ী ঘাট থেকে গড়ে ১০০-১৫০ ট্রাক সার উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হলেও বর্তমানে সেখানে ১০-১৫ ট্রাক সার সরবরাহ হচ্ছে। উল্লেখ্য, অনুমোদিত ঠিকাদার ও আমদানিকারকরা চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে সার এনে এখান থেকে ট্রাকযোগে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে থাকেন। নগরবাড়ী ঘাট থেকে উত্তরাঞ্চলের বিসিআইসির ১৪টি বাফার গুদামে সার সরবরাহ করা হয়। নগরবাড়ী সার আমদানিকারক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক ও বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফা জানান, অবরোধের কারণে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকচালকরা সার পরিবহনে রাজি হচ্ছে না। ফলে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। সরবরাহ কমে যাওয়ায় ঘাটে সার উঠানো-নামানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের উপার্জনও কমে গেছে বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও কৃষিবিদ ড. মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সারের উৎপাদন ও আমদানি হয়ে থাকে সেন্ট্রাল থেকে। এরপর এটা প্রান্তিক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়। অবরোধে ট্রান্সপোর্ট একটা বড় সমস্যা। পরিবহনের সংখ্যা কম থাকলেও ভাড়া বেশি। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। তিনি বলেন, নিয়ম অনুসারে বোরো চাষের শুরুতে ফসফেট, পটাশ ও ইউরিয়া সারের প্রয়োজনীয়তা বেশি। ফসলের মাঠ প্রস্তুতের সময় চাহিদা বেশি। টানা অবরোধে সার সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে এটা নিশ্চিত। এজন্য খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে প্রান্তিক পর্যায়ে সারের দাম ঠিক রাখতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত ‘জেলা সার ও বীজ নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ তেমন কোনো কাজ করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটি সার ও বীজের দাম স্বাভাবিক রাখতে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছে। টানা অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় আইনশৃংখলা বাহিনী নাশকতা ঠেকাতেই বেশি ব্যস্ত। এজন্য সারের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত অভিযোগ এলেও তদন্তের সময় পাচ্ছে না তারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ইউনুছুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, গেল সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সারের দাম বেশি নেয়া হচ্ছে বলে অসংখ্য অভিযোগ পেয়েছি। বাফার গুদামগুলোতে সারের মজুদ ও সরবরাহে ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ানো হচ্ছে। এজন্য স্থানীয় আইনশৃংখলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে আমি নিজে ফোন করেছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এসব অভিযোগের খুব একটা সত্যতা পাওয়া যায়নি। অভিযোগের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সাধারণত বড় ডিলার ও ছোট ডিলারগুলোর মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব থাকে। ফলে একজন আরেকজনের নামে এসব অভিযোগ করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, স্থানীয় আইনশৃংখলা বাহিনীর সহযোগিতা চেয়ে পাইনি এমন নজির নেই। তাই অসহযোগিতার অভিযোগটি ঠিক নয়। যশোরের অভয়নগর প্রতিনিধি এসএম ফারুক আহমেদ জানান, টানা হরতাল-অবরোধের কারণে সারের বৃহত্তম মোকাম নওয়াপাড়া থেকে নন ইউরিয়া সার দেশের উত্তরবঙ্গে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বাজারের সার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নওয়াপাড়া বাজার থেকে ট্রাকে করে সার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। হরতাল-অবরোধের কারণে ট্রাকচালকরা ভয়ে ট্রাকে করে সার নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। নওয়াপাড়া বাজার থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে আড়াইশ’ ট্রাক সার সরবরাহ করা হতো। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে এখান থেকে এখন ১০০ থেকে দেড়শ’ ট্রাকে সার সরবরাহ করা হচ্ছে। এককথায় সার সরবরাহ অর্ধেকে নেমে এসেছে। নওয়াপাড়ায় ইউরিয়া ও নন ইউরিয়া (টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি) সারের আমদানিকারক রয়েছেন ১৩ জন। এসব আমদানিকারকদের আমদানিকৃত সার নওয়াপাড়াসহ চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নগরবাড়ীর মেইন পয়েন্টে গুদামজাত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।  

No comments:

Post a Comment