Monday, June 15, 2015

ভূ-রাজনীতি নয়, স্থানীয় রাজনীতিই ফ্যাক্টর:যুগান্তর

বঙ্গোপসাগরে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের স্থান নির্ধারণ নিয়ে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে সরকার। দীর্ঘদিন আগে কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় এই সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সহায়তার প্রস্তাব দিয়ে রাখে চীন। কিন্তু সম্প্রতি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের স্থান হিসেবে পটুয়াখালীর পায়রার নাম সামনে চলে আসে। অনেকের মধ্যেই একটা ধারণা কাজ করেছে যে, বঙ্গোপসাগরে চীনের কর্মকাণ্ডে প্রতিবেশী ভারতের অস্বস্তির কারণে গভীর স
মুদ্রবন্দরের স্থান পায়রায় স্থানান্তরের চিন্তা করছে বাংলাদেশ। প্রকৃতপক্ষে, এমন ভূ-রাজনৈতিক কারণে নয়, বরং স্থানীয় রাজনীতিই গভীর সমুদ্রবন্দরের স্থান নির্ধারণে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এই তথ্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য সোনাদিয়া ও পায়রা উভয় স্থানই সরকারের ফার্স্ট ট্রেকে আছে। তবে বর্তমানে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে উপযুক্ততা আছে কিনা তার কারিগরি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কাজ করছে ব্রিটিশ পরামর্শক সংস্থা ওয়ার্লিং ফোর্ড। আগামী সেপ্টেম্বরে এই সংস্থা তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করবে। ২০১৮ সালের মধ্যে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর সীমিত আকারে হলেও চালুর একটি লক্ষ্যমাত্রা সরকারের রয়েছে।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বিএনপি সরকারের আমলে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ বিশেষ উদ্যোগী হয়ে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে প্রভাবিত করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা থাকায় নিজের এলাকার কাছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে প্রচেষ্টা চালান। গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য সাতটি স্থান থেকে তাই সোনাদিয়া নির্ধারণে তিনি সফলও হয়েছিলেন। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপিত হলে তার এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাবে। এতে করে স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং এলাকার উন্নয়ন হবে বলে মনে করেছিলেন তিনি। বিএনপি আমলে সোনাদিয়ায় স্থান নির্ধারিত হওয়ার পর পরই চীন এটি নির্মাণে প্রস্তাব দিয়ে রাখে। বিএনপি সরকার অবশ্য ওই স্থানে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে কাজ শুরু করার সময় পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা গভীর সমুদ্রবন্দর পায়রায় নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের যুক্তি, বৃহত্তর খুলনা তথা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তুলনামূলকভাবে অবহেলিত। ওই এলাকায় শিল্প-কারখানা একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। সেই তুলনায় বৃহত্তর চট্টগ্রাম তথা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশি হচ্ছে। পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে প্রধানমন্ত্রীর নিজের জেলা গোপালগঞ্জসহ গোটা অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ওই এলাকায় অনুন্নয়নের জন্য জনমনে যে ক্ষোভ রয়েছে সেটা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে বর্তমানে একটি ব্যস্ত সমুদ্রবন্দর রয়েছে। পাশাপাশি, জাপানি সহায়তায় মহেষখালীর কাছে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রে একটি জেঠি নির্মিত হচ্ছে। মাতারবাড়িতে ওই জেঠি পর্যায়ক্রমে গভীর সমুদ্রবন্দরে পরিণত হবে বলেও অনেকে ধারণা করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী বলেন, ‘মাতারবাড়িতে জাপানি সহায়তায় কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। সেখানে কয়লা আনা-নেয়ার লক্ষ্যে একটি টারমিনাল নির্মিত হচ্ছে। বিষয়টি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও বন্দরবিষয়ক কার্যক্রমে কারিগরি সহায়তা দেবে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়’। এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সোনাদিয়ায় আরও একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর প্রবল চাপ পড়বে। এমনিতেই এই মহাসড়কে অতিরিক্ত চাপের কারণে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এদিকে, সোনাদিয়া ও তার আশপাশে এক ধরনের বিরল প্রজাতির কচ্ছপের বাস রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদীরা ইতিমধ্যেই সরকারের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছে যে, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে ওই প্রজাতির কচ্ছপ বিলীন হয়ে যাবে। এসবই এখন বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সুন্দরবনের কাছে আকরাম পয়েন্টে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণেও প্রস্তাব ছিল। কেননা ওই অঞ্চলে সমুদ্রের তলদেশে একটি নদী আছে। ওই দিক দিয়ে জাহাজ উপকূলের কাছে আকরাম পয়েন্টে চলে আসতে পারবে। কিন্তু সুন্দরবনের পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশংকায় আকরাম পয়েন্টে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী নয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে গেলে সেখানে দুবাই পোর্ট ওয়ার্ল্ড (ডিপি ওয়ার্ল্ড) গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে প্রস্তাব দেয়। চীনের পাশাপাশি অন্যান্য দেশও বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ইতিমধ্যেই নেদারল্যান্ডস সরকার একটি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। জার্মানিও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে কোনো কনসোর্টিয়াম হলে তাতে যোগ দিতে চায়। ভারত আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব না দিলেও মৌখিকভাবে নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। সমুদ্র অর্থনীতিতে সহযোগিতায় আগ্রহী চীন ও ভারত : ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর সমুদ্র সম্পদ আহরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিতে চায় চীন। এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকের খসড়া সরকারের কাছে জমা দিয়েছে দেশটি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সম্পদ তথা নীল অর্থনীতি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। প্রায় একই আদলে চীনও খসড়া জমা দিয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, ভারত ও চীন মূলত সমুদ্র সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের সামর্থ্য বৃদ্ধিতে সহায়তায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ার পর ভারত ও চীনকে পৃথক অঞ্চলে ভাগ করে উভয় দেশের সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশের কোনো অসুবিধা নেই বলে সূত্রটি জানায়।  

No comments:

Post a Comment