তিন মাসের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ একটি মামলার দুই আসামি শামীন মাহফুজ (৩৮) ও ইসমাইল হোসেন (৪০)। একজনের পরিবার থাকে ঢাকার ভাষানটেকে, আরেকজনের কক্সবাজারের চকরিয়ায়। এর মধ্যে উভয় পরিবারের কাছে ডাকযোগে টাকাও এসেছে। কিন্তু কে বা কারা এ টাকা পাঠাচ্ছে, তাও বুঝতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, এঁদের মধ্যে শামীন
ের বাড়ি গাইবান্ধার সদর উপজেলার কলেজপাড়ায়। আর ইসমাইলের বাড়ি চাঁদপুরে। শামীন চকরিয়ায় ও ইসমাইল ঢাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। দুজনই নিজ নিজ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুজনই বান্দরবানের থানচি থানার একটি মামলার জামিনপ্রাপ্ত আসামি। ২০১১ সালের মার্চে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি বান্দরবান আদালতে বিচারাধীন। দুই পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, গত ১৩ এপ্রিল ওই মামলায় বান্দরবানের আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে নিখোঁজ হন শামীন। এর এক সপ্তাহ আগে ৬ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে রাজধানীর উত্তর ভাষানটেকের বাসা থেকে ইসমাইলকে ধরে নিয়ে যায় কয়েকজন লোক। ওই মামলায় শামীনের আইনজীবী ইলিয়াছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১৩ এপ্রিল ধার্য তারিখে শামীন দুপুর ১২টার দিকে হাজিরা দিয়ে আদালত থেকে বের হয়ে যান। পরে তাঁর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পান। তবে বান্দরবান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আ স ম মাহতাব উদ্দিন দাবি করেন, শামীন অপহরণের শিকার হয়েছেন, এমন কোনো তথ্য তাঁরা পাননি। তবে শামীনের খোঁজ পেতে পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। ইসমাইলের স্ত্রী নূরজাহান বেগম প্রথম আলোকে বলেন, সাদাপোশাকে আসা ওই ব্যক্তিরা তাঁর স্বামীকে ‘কিছু প্রশ্ন করে আবার দিয়ে যাওয়ার’ কথা বলে নিয়ে যান। দুজনের নিখোঁজের ঘটনায় ভাষানটেক ও চকরিয়া থানায় পৃথক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তাঁদের পরিবার। দুজনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে একসূত্রে গাঁথা বলে মনে করছে উভয় পরিবার।তাঁদের খোঁজ পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের উচ্চপর্যায়সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই দুজন নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনেছি। আমরা তাঁদের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ তাঁদের মধ্যে শামীন মাহফুজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। তিনি কিছুদিন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলেন। পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, শামীন ২০০৯ সালে গবেষণার কাজে বান্দরবানে যান। সেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে ভুট্টা চাষ প্রকল্প শুরু করেন। এ প্রকল্পে ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন ‘নিখোঁজ’ ইসমাইল। শামীনের একজন নিকটাত্মীয় জানান, একই ধরনের প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বান্দরবানে উপজাতিদের কাছ থেকে আরও দুটি পাহাড় ইজারা নিয়েছিলেন শামীন।২০১১ সালের মার্চে সেখানে বস্তাভর্তি সরঞ্জামাদি পাঠানোর সময় বিজিবি তা আটক করে। বিজিবি দাবি করে, বস্তা থেকে বিভিন্ন জিহািদ বইসহ জঙ্গি-সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে।তখন এ ঘটনায় শামীন, ইসমাইলসহ তিনজনের বিরুদ্ধে থানচি থানায় মামলা হয়।প্রায় দেড় বছর জেল খেটে জামিনে বের হয়ে আসেন তাঁরা।এরপর শামীন একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নিয়ে চকরিয়া চলে যান।সেখানে পরিবার নিয়ে থাকেন। আর ইসমাইল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকার উত্তর ভাষানটেকে ভাড়া বাসায় ওঠেন এবং মাটিকাটা এলাকার ফুটপাতে গেঞ্জির ব্যবসা শুরু করেন। উভয় পরিবার থেকে জানানো হয়, ৮ মে ডাকযোগে চকরিয়ায় শামীনের স্ত্রীর নামে ২০ হাজার টাকা পৌঁছে। প্রেরক হিসেবে লেখা ‘আবদুল হাকিম, উত্তরা সেক্টর-১৩, রোড-১৩, হাউস-৫’ লেখা আছে। আর ইসমাইলের স্ত্রীর কাছে ভাষানটেকের বাসার ঠিকানায় ডাকযোগে ১০ হাজার টাকা আসে। তাতে প্রেরক হিসেবে লেখা ছিল ‘শহীদুল ইসলাম, উত্তরা, ঢাকা’। উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ওই ঠিকানায় গেলে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক জুয়েল রানা প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িতে আবদুল হাকিম নামের কেউ থাকেন না। শামীনের এক ভাই জানান, ১ মে রাতে একটি অচেনা নম্বর থেকে মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন শামীন। প্রায় পাঁচ মিনিট কথা হয়। কিন্তু শামীন কোথায় আছেন, কেমন আছেন কিছুই বলেননি। শুধু আমতা-আমতা করে বলেন, তাঁর স্ত্রী-সন্তানের জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছেন। এর পর থেকে ওই ফোন নম্বর বন্ধ আছে। এ বিষয়ে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, তদন্তে দেখা গেছে ওই ফোনের সিম ব্যবহার করে শুধু একবারাই ফোন করা হয়েছে। আগে-পিছে কোনো কল নেই।
No comments:
Post a Comment