বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ, সঙ্গে মাঝেমধ্যে হরতালে নিরীহ মানুষকে শুধু প্রাণে মেরেই ক্ষান্ত হচ্ছে না দুর্বৃত্তরা—ট্রেন, বাস-ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি অন্যতম লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ের ভূমি অফিসও। এতে গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথিপত্র পুড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেই নিরীহ মানুষই; নানাভাবে জিম্মি হচ্ছেন সহিংস রাজনীতির। অতীতে
সরকারি দপ্তরগুলোকে নিশানা করে এ ধরনের নাশকতা চালানোর ঘটনাও বিরল। অবরোধের গত ৭০ দিনে সরকারি দপ্তরে সংঘটিত নাশকতার ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এই কয়েক দিনে অন্তত ১৩টি জেলার ১৭টি ভূমি অফিসে পেট্রলবোমা হামলা বা দাহ্য পদার্থ ঢেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সর্বশেষ হামলা হয়েছে ভোলার দৌলতখান উপজেলার উত্তর জয়নগর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। গত শনিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে অফিসটির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে যায়। স্থানীয় লোকজন দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হওয়ায় আরও বড় ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে। সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা এসব হামলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ভূমি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা করছে। জমির প্রকৃত মালিকদের উচ্ছেদ করে জাল দলিলের মাধ্যমে জমি দখল করা, ক্ষেত্রবিশেষে জমির প্রকৃত মালিকদের হয়রানিতে ফেলাই তাদের এ হামলার লক্ষ্য। স্থানীয় লোকজন বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকার কারণেই রাতের আঁধারে এ হামলা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। গত প্রায় আড়াই মাসে এতগুলো ভূমি অফিসে হামলার ঘটনা ঘটল অথচ নাশকতাকারীদের ধরতে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়নি স্থানীয় লোকজন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে। এ সময়ের মধ্যে এ ঘটনাগুলোতে আটটি মামলা করার খবর মিলেছে। গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়েছে ১৭ জনকে। সংঘটিত হামলাগুলো ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে গত ১১ মার্চ রাতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও আসবাব পুড়ে যায়। কার্যালয়ের আশপাশের বাসিন্দারা জানান, ভোর চারটার দিকে কার্যালয়ে আগুন দেখে তাঁরা গিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে আনেন। এর আগেই ভেতরের রেকর্ড বইসহ আসবাব পুড়ে যায়। ইউনিয়নের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা আতিকুর রহমান জানান, আগুনে ১৪টি মৌজার রেকর্ড বই, ডিসিআর বইসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও মালামাল পুড়ে গেছে। ঝালকাঠির সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতাহার মিয়া বলেন, কার্যালয়ে যারা আগুন দিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। আসামি পোনাবালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ওয়ারেচ আলী খান, তাঁর ছেলে ছাত্রদল নেতা আনিসুর রহমান, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হেলাল মল্লিক ও বাদল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলোঘর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ৮ মার্চ আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অফিসের প্রধান দরজা ও কয়েকটি জানালা। নোয়াখালী সদর উপজেলা ভূমি অফিসে ৭ মার্চ রাত সাড়ে তিনটার দিকে পেট্রলবোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে তিনটি জানালা, পর্দা ও কিছু নথিপত্র পুড়ে যায়। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সামছুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত চলছে। এর আগে ১৮ ফেব্রুয়ারি বেগমগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে এ ঘটনায় অফিস সহকারীর কক্ষ, নথিপত্র ও মালামাল পুড়ে যায়। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘কার্যালয়ে কোনো নৈশপ্রহরী নেই। আদিকাল থেকেই একেবারে সাদামাটা পরিবেশে এ অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কখনোই কোনো সমস্যা হয়নি। স্থানীয় লোকজনই নিজেদের প্রয়োজনে এ অফিসের দেখভাল করে থাকেন। এখন কেন এ অফিসকে নাশকতার লক্ষ্যবস্তু বানানো হলো তা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা হয়েছে। কেউ আটক হননি।’ ফেনীর ছাগলনাইয়া ভূমি কার্যালয়ের টিনশেড ভবনে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে তিনটার দিকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে জরুরি কাগজপত্রসহ কার্যালয়টি পুড়ে যায়। এ ঘটনায় মামলা হলে সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ রাধানগর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রবিউল হক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পোদ্দার বাজারে বশিকপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে ৬ মার্চ ভোররাত চারটার দিকে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় কার্যালয়ের আসবাব ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে যায়। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সমর কান্তি বসাক বলেন, দুর্বৃত্তরা এ অফিস হামলার জন্য বেছে নিয়েছে। কারণ, সাধারণ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে গেলে তাদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। হামলার পর অফিসের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে বন্দর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ১ মার্চ রাতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। অফিসে জানালার ফাঁক দিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয় তারা। অফিসের একটি দরজা পুড়লেও সৌভাগ্যবশত নথিপত্র অক্ষত থাকে। মাগুরা সদর উপজেলা ভূমি অফিসে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। অফিসের পেছনের একটি ভাঙা জানালা দিয়ে কেরোসিন ঢেলে এ আগুন দেওয়া হয়। ঘটনা টের পেয়ে স্থানীয় লোকজন তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নিভিয়ে ফেলায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কোটাকোল ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত দুইটার দিকে। লাঠির মাথায় কাপড় বেঁধে তাতে আগুন ধরিয়ে জানালা দিয়ে এ আগুন লাগানো হয়। আগুনে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে যায়। এ ঘটনায় পুলিশ লোহাগড়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও লাহুড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান জি এম নজরুল ইসলামসহ বিএনপি ও জামায়াতের ২২ নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা করে। মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফরিদপুর সদরের কানাইপুর বাজারসংলগ্ন তহশিল অফিসে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এলাকাবাসী তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভাতে সক্ষম হওয়ায় তেমন ক্ষতি হয়নি। এর আগে ১৩ জানুয়ারি রাতে ফরিদপুর সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের একটি কক্ষে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আমিনুজ্জামান বলেন, ভূমি অফিসে আগুন লাগানোর ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ এ অফিসগুলো ফাঁকা স্থানে ও জরাজীর্ণ ভবনে হওয়ায় সহজেই আক্রান্ত হচ্ছে। সদরের ইউএনও মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, জমিজমা নিয়ে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা ভিপি সম্পত্তি অবমুক্ত করার কারণে সংক্ষুব্ধ হয়ে কেউ এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। রাজশাহীর বাঘা উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ইউএনও বাদল চন্দ্র হালদার বলেন, আগুনে কাযালয়ের রেকর্ড রুমে নিষ্পত্তি করা বেশ কিছু নথি ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ের বিতরণের পর বেঁচে যাওয়া প্রায় ৫০০ বই পুড়ে গেছে। এর দুদিন আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি চারঘাট উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। পুড়ে যায় আসবাব ও নথিপত্র। কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী মামুনুর রশিদ জানান, তিনি ও তাঁর সহকর্মী সরফুউদ্দিন রাতে কার্যালয়ের পাহারায় ছিলেন। ভোর পাঁচটার দিকে বিকট শব্দ শুনে তাঁরা সার্ভেয়ারের কক্ষে গিয়ে দেখেন সেখানে আগুন জ্বলছে। ভাঙা জানালা দিয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। এরও কয় দিন আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি একই উপজেলার সারদা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে কয়েকটি জানালা পুড়ে গেলেও নথিপত্র অক্ষত থাকে। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জাকিউল ইসলাম জানান, ভোররাতে কার্যালয়টিতে কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগানো হয়। এসব হামলার ঘটনায় দুই থানায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। বাঘায় এ পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেন ভূমি অফিসে আগুন লাগানো হয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে চারঘাটের ইউএনও রাসেল সাবরিন বলেন, ভূমি অফিসের রেকর্ডপত্র পুড়িয়ে দিতে পারলে ভূমি জালিয়াতি চক্রের সুবিধা হবে। এর বাইরে কোনো বিষয় থাকলে পুলিশি তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। ময়মনসিংহ সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে নয়টার দিকে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগায় দুর্বৃত্তরা। সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন বলেন, আগুনে প্রায় ১০০ গুরুত্বপূর্ণ দলিল পুড়ে গেছে। নথিগুলো পুনরায় সংগ্রহ করা হয়েছে। পুড়ে যাওয়া বেশির ভাগ নথিই ছিল নামজারির আবেদনের। পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানায় করা একটি মামলায় চারজনকে আটক করা হয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে গত ২৯ জানুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে পেট্রলবোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। রাতে কার্যালয়ের পাহারায় ছিলেন মো. আনিছ। তাঁকে ফাঁকি দিয়েই দুর্বৃত্তরা কার্যালয়ের নবনির্মিত অংশের জানালা ভেঙে ভেতরে বোমা ছোড়ে। পরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গিয়ে আগুন নেভান। হামলায় নামজারি, মিস মামলা, ভিপি মামলা, রেজিস্টার বইসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০০ নথিপত্র পুড়ে যায়। এ ঘটনায় একটি মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের পাঁচ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। {প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা}
No comments:
Post a Comment