বিশ্বকাপ অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে, অর্ধেক আছে। আর্জেন্টিনার সুবাদেই সেটুকু ছিল। অর্থাৎ সবাই বিদায় নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার এই পরাশক্তি টিকে ছিল বলেই মারাকানার আকর্ষণ শেষ পর্যন্ত ছিল। ফাইনালে স্ব্বাাগতিকরা না থেকেও ছিল। এই বিশ্বকাপের ফাইনালে আরো দুই রকম লাইন-আপের সুযোগ ছিল। অল ইউরোপ অথবা পুরোটই দক্ষিণ আমেরিকার লড়াই। শেষেরটা নিয়ে টুর্নামেন্টের আগে থেকে এখানকার মানুষ উচ্চকিত ছিল, প্রথমবারের মতো ব্রাজিল-আর্জেন
্টিনা ফাইনাল হবে। সেদিকে গিয়েও গেল না শেষমেশ, দেশের মাঠে সেলেসাওদের মহাপতনের বিষাদসিন্ধু লিখতে হয়েছে স্বাগতিক মিডিয়ার। হলে রিও ডি জেনিরো বিশ্বের সবচেয়ে আনন্দ-নগরী হয়ে উঠত। কী অপরূপ তার সাজ নিয়ে সে কোলাহলমুখর হতো! হয়নি বোধ হয় রিওর লোভাতুর ব্যবসায়ীদের জন্য, ১০ টাকার জিনিস এক হাজার টাকায় বিক্রির জন্য বসেছিল তারা। অল ইউরোপ হলে ফাইনালের আগেই সব শেষ হয়ে যেত। নেদারল্যান্ডস ফাইনালে ওঠেনি, সেটা মারাকানার ভাগ্য। তারা শুধু মাঠের খেলাটিকেই দেখে, মাঠের বাইরের নানা অনুষঙ্গে যে খেলাটা জীবনের রং ধারণ করে, সেটা তারা কখনো ফুটিয়ে তুলতে জানে না। নেদারল্যান্ডস ওঠেনি, সেটা মারাকানার ভাগ্য। আর্জেন্টিনা গিয়ে তাকে বাঁচিয়েছে, তাদের সমর্থকদের উৎসব, আয়োজন আর ফুটবলের প্রতি ভালোবাসায় ফাইনাল এবং মারাকানার আকর্ষণ টিকে ছিল শেষ পর্যন্ত। রিওর মাঠেঘাটে তাদের সরব উপস্থিতি বারবার জানান দিচ্ছিল ২৮ বছর পর এবার তাদের পালা। ২৪ বছর পর জার্মানির পালা বলে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা থাকলেও সাধারণ জার্মানরা এই দাবিকে ফুটবল ভালোবাসার মোড়কে বাঁধতে জানে না। তাদের উপস্থিতিও ছিল খুব সামান্য। তাদের হয়ে লড়ছে স্বাগতিকরা, সাত গোলের পরও লাজ-সরমের মাথা খেয়ে জার্মান জার্মান করছে। এটা মূলত আর্জেন্টিনাবিদ্বেষ থেকে, প্রতিবেশীদের হারানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। জার্মানির হয়ে বলছে নানা কথা। তিনবারের চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে বলার মতো অনেক কিছুই আছে, তারায় তারায় খচিত দলটি তো টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ, ফাইনালে উঠতে কোনো ম্যাচেই দিতে হয়নি টাইব্রেকার পরীক্ষায়। আর্জেন্টিনা উঠেছে কাঠখড় পুড়িয়ে, এর পরও শক্তি হলো মেসি-ম্যাজিকে সব বাধা অতিক্রম করে শিরোপা জিতবে আলবিসেলেস্তেরা। এই শিরোপা ভাবনা ফাইনালটাকে না মাধুর্যহীন হয়ে পড়ে, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সাবেক আর্জেন্টাইন ফুটবলার হুয়ান পাবলো সরিন এখন ইএসপিএন ব্রাজিলের সাংবাদিক, তিনি আর্জেন্টিনার জয়ের পাশাপাশি চাইছেন দুর্দান্ত এক ফাইনাল, 'আমি সাংবাদিক হয়ে প্রথমবারের বিশ্বকাপ কাভার করছি (হাসি)। দারুণ একটা ফাইনাল দেখতে চাই, দুই দলের মধ্যেই ভালো ফুটবল খেলার সামর্থ্য আছে। আমি চাই, লড়াইটা হয়ে উঠুক মেসি বনাম জার্মানির, মেসির শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এ লড়াইটা তার জেতা উচিত।' তাতে আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিশ্বকাপ জয় হবে, চারবারের ব্যালন ডি'অর জয়ী লিওনেল মেসির ফুটবল জীবন পূর্ণতা পাবে। জার্মানরাও তো এই মেসিতে এসে আটকে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনার সঙ্গে দলগত পারফরম্যান্সের তুলনায় জার্মানি এগিয়ে থাকে, এর পরও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না আর্জেন্টাইন জাদুকরের জন্য। তাকে বোতলবন্দি করে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্যামি খেদিরাকে। জার্মান সাংবাদিকদেরও ভয় এ আর্জেন্টাইন মহাতারকাকে নিয়ে, তাঁরই ক্ষমতা আছে সব শক্তিকে টলিয়ে শিরোপা জেতার। এর আগে সব কৌশলের মারপ্যাঁচ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে ২৭ বছর বয়সী এ ফুটবলারকে। তিনি সফল হলেই জার্মানি-আর্জেন্টিনার ফাইনালটা জমজমাট হবে। এটা যদিও বেশির ভাগ ব্রাজিলিয়ান চায় না, কেউ কেউ আছে জার্মানির পক্ষ না নিয়ে নিখাদ বিশ্বকাপের মহামঞ্চে মহাতারকার বিস্ফোরণ দেখতে চায়। সে রকম এক ব্রাজিলিয়ান টিভি ক্রু পেদ্রোর চাওয়া, 'আমি ব্রাজিলিয়ান তবে ব্যক্তিগতভাবে মেসির ভক্ত। সেরা দলের সঙ্গে সেরা খেলোয়াড়ের লড়াইটা দেখাই আমার উদ্দেশ্য।' এই লড়াই দেখার আগে থেকেই বিশ্ব ফুটবলের মিলন মেলায় বিদায়ের রাগিনী বেজে উঠেছে। গত এক মাসে কত রঙের আর কত ভাষাভাষি মানুষের জমায়েত হয়েছিল এই ব্রাজিলে, তার ইয়ত্তা নেই। নিজের দলের খেলা দেখতে কিংবা বিশ্ব ফুটবলের রস উপভোগ করতে তারা এসেছিল ফুটবলের দেশে। টিকিট থাকলে মাঠে গিয়ে নইলে ফেনফেস্টে হাজার হাজার জনতার ভিড়ে মিশে গিয়েছিল। সেখানে স্বাগতিক আর ভিন দেশির বিভেদ ছিল না, সবাই ফুটবলানুরাগী। দ্বিতীয় রাউন্ড শেষ হওয়ার পর থেকে গণ-জমায়েতে মানুষের বৈচিত্র্যে ভাটার টান শুরু হয়। বহু রঙের মানুষ বিদায় নিয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে রয়ে গেছে আর্জেন্টাইনরা, সঙ্গে কিছু জার্মান। তারাও আজ ফিরে যাবে নিজেদের দেশে, কেউ উৎসবের রং মশাল হাতে নিয়ে, কেউ-বা ফাইনাল হারের বেদনা নিয়ে।
No comments:
Post a Comment