আবদুল আজিজ অজ্ঞান পার্টির গুরু হিসেবে পরিচিত। লোকজনকে কিভাবে ঘায়েল করতে হয় তার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ আছে তার। ঢাকায় গড়ে তুলেছে একাধিক প্রতারক গ্রুপ, অজ্ঞান পার্টি। এ পর্যন্ত আজিজ গ্রেপ্তার হয়েছে ২২ বার। কিন্তু তাকে বেশি দিন থাকতে হয়নি কারাগারে। গত ছয় মাসে তার মতোই শতাধিক অজ্ঞান পার্টির সদস্য কারাগার থেকে বের হয়ে আবার অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে রাজধানীসহ সারা দেশে অজ্ঞান পার্টির তৎপ
রতা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই এসব চক্রের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল এবং রেল স্টেশন ও মার্কেটের ভেতর ও বাইরে ওত পেতে থাকে প্রতারকরা। সুযোগ মিললেই অচেতন করে লুটে নিচ্ছে নগদ টাকা ও অন্য মালপত্র। তবে অনেক ঘটনার খবরই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কানে পেঁৗছাচ্ছে না। শুধু রাজধানীতেই এই চক্রের অর্ধশতাধিক গ্রুপ নানাভাবে সক্রিয় বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী গত এক মাসে অন্তত ৩০০ নারী-পুরুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছে। তাদের তৎপরতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে নগরবাসী। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতারকদের তৎপরতা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি পিছিয়ে নেই। ইতিমধ্যে অজ্ঞান পার্টির একাধিক নেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও অনেকেই জামিনে কারাগার থেকে বের হয়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তার পরও আমাদের অভিযান ও তৎপরতা থেমে নেই।' গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দিনকে দিন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। গ্রুপের সদস্যরা প্রতিনিয়ত নারী-পুরুষদের ঘায়েল করে লাখ লাখ টাকা বা মালপত্র হাতিয়ে নিচ্ছে। আবার তাদের রুখতে পুলিশ ও র্যাব নানাভাবে তৎপর। থানা পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাব আলাদাভাবে ওই সব প্রতারকের তালিকার পর তালিকা করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, থামছে না অপরাধ কর্মকাণ্ড। মাঝেমধ্যে কিছু সদস্য গ্রেপ্তার হলেও আইনি দুর্বলতার কারণে তারা সহজেই কারাগার থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ফুটপাত, লঞ্চঘাট, রেল বা বাস স্টেশন, হাটবাজার ও বিপণিবিতানসহ জনবহুল জায়গায় হকার হিসেবে অবস্থান নেয়। তারা ডাবের পানি, জুস, চা, কফি, পান, খেজুর, ঝালমুড়ি, শক্তিবর্ধক হালুয়া, ক্রিমজাতীয় বিস্কুট, চকোলেট, রঙিন পানীয় ইত্যাদি বিক্রি করে। আবার কখনো এরা যাত্রীবেশে লঞ্চ, বাস বা ট্রেনে উঠে সরাসরি কারো সঙ্গে সখ্য গড়ে তাদের খাদ্যদ্রব্য ব্যবহার করে। যেসব গ্রুপ সক্রিয় : সূত্র জানায়, পুলিশ-র্যাব ও পুলিশের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা সমপ্রতি অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যদের একটি তালিকা করে। তালিকা নিয়ে পুলিশের সদস্যরা বিভিন্ন স্থান চষে বেড়াচ্ছেন। তালিকার মধ্যে যারা সক্রিয় তারা হলো উত্তরায় সবুজ, জনি; মহাখালী ও গুলশানে আবুল, সোহরাব, মিজু-মিন্টু; তেজগাঁওয়ে শরীফ, শিপন, লাভলী, রাহেলা, ইয়াকুব, মনির-মামুন, হাসি; যাত্রাবাড়ী-শ্যামপুর-ধোলাইপাড় ও কদমতলীতে শাহজাহান, মজিবুর, শাহজালাল, আজমত, কালা সেন্টু, নান্টু, রনি, নান্নু, উজ্জল; কেরানীগঞ্জে মতিন, শিপন, শাহিন, ইদ্রিস, জাহিদ; পুরান ঢাকার লালবাগ ও হাজারীবাগে টোকাই নূর ইসলাম, মতিঝিলে মেয়র রফিক, গাজী মোস্তফা, কামাল লিংকন, শাহবাগে মুন্না, ল্যাংড়া ইসলাম; সদরঘাটে লোকমান, টঙ্গীতে মাসুম চৌধুরী, সালাম, শাহীন, পিচ্চি আলম, মটকু দুলাল, হাশেম, গিয়াস উদ্দিন গ্রুপ অন্যতম। অজ্ঞান পার্টির বিরুদ্ধে কোন ধারায় মামলা : পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, অজ্ঞান করে মানুষের ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যাওয়ায় সাধারণত ৩২৮ ও ৪২০ ধারায় মামলা করা হয়। ৩২৮ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ ধরনের (অজ্ঞান পার্টি) অপরাধীর বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। আইনের ফাঁক গলে তারা সাত থেকে ১৫ দিন না হয় এক মাসের মধ্যে সহজে বের হয়ে যায়। আদালতপাড়ায় তাদের হয়ে কাজ করছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। তারা ধৃতদের দ্রুত জামিনে বের করে আনে। এ জন্য সর্বোচ্চ তাদের ব্যয় হয় ৫০ হাজার টাকা। অনেক সদস্যকে হাতেনাতে গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা (৩০৭ ধারা), চেতনাহীন করা (ধারা ৩২৮) ও চুরির (ধারা ৩৭৯) মামলা দেওয়া হয়। কিন্তু আদালতে যাওয়ার পর তারা জামিনে পার পেয়ে যায়। যারা প্রতারণার শিকার : হাসপাতাল সূত্র মতে, গত এক মাসে প্রায় ৩০০ নারী-পুরুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছে। গত রবিবার রাতে বিমানবন্দর সড়কের আর্মি অফিসার্স মেসের সামনে চালক রহিমকে অজ্ঞান করে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে পালানোর সময় অজ্ঞান পার্টির দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রহিম বলেন, "উত্তরা থেকে ভদ্রবেশে দুই প্রতারক তাঁর সিএনজিতে ওঠে। একপর্যায়ে তারা গল্পগুজব করতে থাকে। খিলক্ষেতে আসার পর এক প্রতারক বলে, 'সারা দিন রোজা রেখেছি। চা খাওয়া হয়নি। কোনো দোকানের সামনে দাঁড় করান।' পরে চায়ের দোকানে গাড়ি দাঁড় করালে দুজন নেমে পড়ে। আমাকে চা খেতে বললে আমি রাজি হইনি। পরে তারা অনুরোধ করতে থাকলেই চা খাই। চা খাওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যে চোখে ঘুম চলে আসে। চলন্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ার উপক্রম হলে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাই। এই সুযোগে তারা সিএনজি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। এক পথচারী দৃশ্যটি দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে। পরে পুলিশ দুই প্রতারককে ধরে ফেলে। আর আমাকে ভর্তি করে হাসপাতালে।" রহিমের মতে অনেকই এভাবে প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। গত ২ জুলাই গোপীবাগে বাসার সবাইকে অচেতন করে মালপত্র নিয়ে চম্পট দেয় এক গৃহকর্মী। ২৫ জুন সায়েদাবাদে বাসের মধ্যে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ছয় লাখ টাকা খোয়ান নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তিনি বিদেশে যাওয়ার জন্য টাকা নিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসছিলেন। ১৫ জুন বাড্ডার বটগাছিয়া এলাকায় একই পরিবারের পাঁচ সদস্য অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে। ১১ জুন রাতে রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় এক দম্পতিকে অজ্ঞান করে দুই ভরি স্বর্ণ ও ৯৫ হাজার টাকা লুট করা হয়। ১০ জুন কারওয়ান বাজারে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের (এনএসআই) এক কর্মকর্তার গাড়িচালক মো. হান্নান (৫০) টাকা ও মোবাইল ফোনসেট হারিয়েছেন। একই দিন গাবতলী বাস টার্মিনালে প্রতারকদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারানোর পাশাপাশি তিন দিন অচেতন ছিলেন আইইউবির ছাত্র জুলহাস। ১২ জুলাই মুক্তিযোদ্ধাসহ ৯ জন অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে। এনামুল হক বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উদ্দিন (৬২), আবদুর রহমান (৬০) ও দেবী রঞ্জনকে (৬২) অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এ ছাড়া হাতিরঝিল থেকে অচেতন অবস্থায় সিএনজিচালক জাহাঙ্গীর (৫০), গুলিস্তান থেকে আবদুল হক (৪০), আলম শিকদার (৩৫), শেখ বাতেন (৫৫), চাঁন মিয়া (২৮) ও অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তিকে (৪০) অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রতারকরা তাদের নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়। ডিবির এক ইন্সপেক্টর কালের কণ্ঠকে জানান, প্রতারকরা সংঘবদ্ধ চক্র। চার-পাঁচজন এক দলে কাজ করে। প্রথমে অপরাধীদের মধ্য থেকে দু-একজন টার্গেট হওয়া ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চালায়। সে ইশারা দিলে অজ্ঞান পার্টির বিক্রেতা বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী বিক্রির ছলে তাদের কাছে চলে আসে। একপর্যায়ে টার্গেট ব্যক্তির বিশ্বাস স্থাপনের জন্য প্রতারক সদস্য তাদের সদস্যদের কাছ থেকে খাবার কিনে খেতে থাকে। একই সঙ্গে টার্গেট হওয়া ব্যক্তিকে খাবার খেতে প্ররোচিত করে। ওই ব্যক্তি সম্মত হলে তাকে ট্যাবলেট মেশানো খাবার খাওয়ানো হয়। খাবার খেয়ে পাঁচ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে ওই ব্যক্তি অচেতন হলে তার কাছ থেকে মূল্যবান দ্রব্যাদি নিয়ে চম্পট দেয় তারা। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে প্রাইভেট কার, সিএনজি, রিকশা, মোবাইল, টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান দ্রব্যাদি হাতিয়ে নেয়। ঈদ ও রমজান এলে তারা বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠে। ঢাকা ছাড়া তারা অন্য জেলাগুলোতেও তৎপর।
No comments:
Post a Comment