Sunday, July 20, 2014

রুশ-পশ্চিম টানাপড়েনে নতুন মোড়:নয়াদিগন্ত

বিস্ময় কাটেনি এখানো, ইউক্রেনের রাবোভো গ্রামের মাঠে ছড়িয়ে থাকা এমএইচ১৭-এর ধ্বংসস্তূপ এখানো বলতে পারেনি কেন ঝরে গেল প্রায় ৩০০ প্রাণ। এ দিকে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর তদন্তের দাবির মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের টানাপড়েন নিয়েছে নতুন মোড়। রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মস্কোর মদদে ইউক্রেন-রুশ সীমান্ত অঞ্চলে ভূপাতিত মালয়েশিয়ান উড়োজাহাজের আলামত ধ্বংসের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছে কিয়েভ সরকার। গতকাল শন
িবার স্থানীয় সময় সকালে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়, রাশিয়ার সহযোগিতায় সন্ত্রাসীরা এই আন্তর্জাতিক অপরাধের আলামত নষ্টের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা সেখান থেকে ৩৮টি লাশ সরিয়ে ফেলেছে এবং ইউক্রেনিয়ান তদন্ত দলকে ঘটনাস্থলে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে তাৎণিকভাবে রুশ সরকার বা মস্কোপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রয়টার্স, এএফপি।  এ দিকে বিধ্বস্ত বিমানের ‘ব্ল্যাকবক্স’ নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও রাশিয়া ও ইউক্রেন কর্তৃপ পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ছোড়া পেণাস্ত্রে মালয়েশিয়ার ওই উড়োজাহাজ ভূপাতিত হয়েছে। মস্কোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করার অভিযোগ তুলে তাদের সমর্থন করা থেকে বিরত থাকার জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ওবামা। অন্য দিকে বিমান ভূপাতিত হওয়ার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। শুক্রবার হোয়াইট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবামা বলেন, ‘ইউক্রেনের সহিংসতা আর অস্থিরতা দমানোর সবচেয়ে বেশি মতা আছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের। পুতিন সিদ্ধান্ত নিলে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ ও লড়াই দুই-ই বন্ধ হতো। কিন্তু তিনি তা করেননি। ‘উল্টো ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রাশিয়ার কাছ থেকে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রসহ ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র পেয়ে আসছে।’ বিদ্রোহীদের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার না করলে মস্কোর ওপর আরো কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন বলেও জানান ওবামা। বিমান ভূপাতিতের ঘটনায় ইউরোপই সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ওবামা দৃশ্যত মস্কোর ওপর ওয়াশিংটন যে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সে পথে এগোনোর জন্য ইউরোপকে উৎসাহ যুগিয়েছেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। তবে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেল বলেছেন, ওই বিমানে আসলে কী ঘটেছিল তা স্পষ্ট হওয়ার আগে মস্কোর ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। যুক্তরাজ্য বলেছে, মস্কোর ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বিবেচনার আগে জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বে তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা বের করতে হবে। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলেও বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার ‘নিরপে’ আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউক্রেনের দোনেস্ক শহরের কাছের রাবোভো গ্রামে বোয়িং নির্মিত ৭৭৭ মডেলের এমএইচ১৭ বিধ্বস্ত হলে ২৯৮ জন আরোহীর সবাই নিহত হন বলে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন। আমস্টারডাম থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরগামী ওই ফাইটে নেদারল্যান্ডসের অন্তত ১৮৯ জন নাগরিক ছিলেন। তাদের মৃত্যুতে একদিনের জাতীয় শোক পালন করেছে নেদারল্যান্ডসবাসী। বৃহস্পতিবারকে নেদারল্যান্ডসের জন্য ‘কালো দিন’ বলে অভিহিত করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক রাট। এ দিকে শুক্রবার মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর ভারী হয়ে ওঠে বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের নিহত যাত্রীদের স্বজনদের আহাজারিতে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের তথ্য অনুযায়ী, ওই ফাইটে ১৫ জন ক্রুসহ মালয়েশিয়ার ৪৪ জন নাগরিক ছিলেন। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ২৭ জন, ইন্দোনেশিয়ার ১২ জন এবং নয়জন ব্রিটেনের নাগরিক ছিলেন। পেণাস্ত্র নিপে করে বিমান বিধ্বস্তে প্রাণহানির এ ঘটনাকে ‘অবর্ণনীয় অপরাধ’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোট। এ দিকে ঘটনা খতিয়ে দেখতে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের ‘সম্মতি’ নিয়ে শুক্রবার ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন অর্গানাইজেশন ফর দ্য সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপের (ওএসসিই) তদন্ত দলের সদস্যরা। তাদের তদন্ত কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন ওএসসিই-এর চেয়ারম্যান রোনাল্ড ব্লেস। এ কাজে তদন্ত দল ও ইউক্রেন কর্তৃপকে সহযোগিতা করার জন্য ওই এলাকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওএসসিই। তবে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার এলাকা আন্তর্জাতিকভাবে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হলেও সেখানে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ থাকায় তদন্তে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ওএসসিই-এর চেয়ারম্যান ব্লেস। বিধ্বস্ত বিমানের নিহত যাত্রীদের শনাক্ত করতে মালয়েশিয়া থেকে একটি দল ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ পৌঁছেছে। ওই প্রতিনিধিদলে মালয়েশিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশের ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ, সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তা, দুর্যোগ মোকাবেলা বিভাগের কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন। ১৪৯ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদল মূলত মৃতদের শনাক্ত করবে বলে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দফতরবিষয়ক মন্ত্রী দাতুক সেরি সাহিদান জানিয়েছেন। মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ওই উড়োজাহাজ ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা বিপর্যয় ডেকে এনেছে বিশ্বের এইডস গবেষণা অঙ্গনেও। ওই ফাইটে শীর্ষ কয়েকজন এইডস বিশেষজ্ঞসহ ১০০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ছিল, যারা এ বছরের এইডস সম্মেলনে যোগ দিতে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন যাচ্ছিলেন। ওই বিমানে আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন ডাচ এইডস বিশেষজ্ঞ ইওপ লাঙ্গেসহ ডজন খানেক এইডস বিশেষজ্ঞ নিহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইওপকে এইডস চিকিৎসার একজন পথিকৃত ধরা হয়। তিনি ৩০ বছর ধরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতের নাগালে এইডস চিকিৎসা পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে কাজ করে আসছিলেন। জাতিসঙ্ঘের এইডস প্রোগ্রামের (ইউএনএইডস) পে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ‘কিছু সেরা বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্য আন্দোলনকারীকে আমরা বিমানটির সাথে হারিয়েছি।’ ওই ঘটনার পর সতর্কতার অংশ হিসেবে দেশের পূর্বাঞ্চলে যেকোনো ধরনের বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউক্রেন কর্তৃপ। নিষেধাজ্ঞা জারির পর দুর্ঘটনাস্থলের আকাশ পথ ব্যবহার না করে বেশ কিছু এয়ারলাইন্স নিজেদের রুট পরিবর্তন করেছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের ট্রান্সপোর্ট বিভাগ। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স। মাত্র চার মাসের মাথায় বিমানের দু’টি বিপর্যয়কর ঘটনায় ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় পড়েছে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স। এমএইচ-১৭ বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার খবরে মালয়েশিয়ার স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার পড়ে যায় ১১ শতাংশ।  নিহত যাত্রীদের পরিচয় প্রকাশ : ইউক্রেনে বিধ্বস্ত হওয়া মালয়েশীয় উড়োজাহাজ ফাইট এমএইচ-১৭’র নিহত ২৯৮ আরোহীর সবার পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। গতকাল শনিবার মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের (এমএএস) দাফতরিক ওয়েবসাইটে দেয়া এক বিবৃতিতে নিহত যাত্রীদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়। এতে জানানো হয়, নিহত ২৯৮ জন যাত্রীর মধ্যে নেদারল্যান্ডসের নাগরিক ছিলেন ১৯২ জন (এদের মধ্যে একজন নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক), ৪৪ জন মালয়েশীয় (এদের মধ্যে ১৫ জন ক্রু ও দুইজন শিশু), ২৭ অস্ট্রেলীয়, ১২ জন ইন্দোনেশীয় (এক শিশুসহ), ১০ জন ব্রিটিশ (একজন যুক্তরাজ্য ও দণি আফ্রিকার  দ্বৈত নাগরিক), চারজন জার্মান, চারজন বেলজিয়ান, তিনজন ফিলিপিনো, একজন কানাডীয় ও অপর একজন নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। নিহতদের সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করার জন্য এমএএস যেসব দেশের নাগরিকেরা নিহত হয়েছেন তাদের দূতাবাসগুলোর সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করছে। কুয়ালালামপুরগামী মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের এমএইচ-১৭ ফাইটটি বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে রুশ সীমান্তের কাছে বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনায় বিমানটির ১৫ জন ক্রুও ২৮৩ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন।  এর আগে গত ৮ মার্চ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের এমএইচ ৩৭০ ফাইট ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে মাঝ আকাশে নিখোঁজ হয়ে যায়। ব্যাপক আন্তর্জাতিক চেষ্টার পরও বিমানটির কোনো হদিস এখনো পাওয়া যায়নি। মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের অর্থায়নকারী ডিভিবি ব্যাংকের এভিয়েশন বিভাগের প্রধান বার্টান্ড গ্রাভোস্কি বলেন, ‘এটি পুরোপুরি কাকতালীয়। কিন্তু ইতিহাসে এমন আগে কখনো হয়নি যে একই এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হারিয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পরেই এমন একটি ঘটনা ঘটেছে।’ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সকে বাঁচাতে দেশটির সরকারের সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ দিকে বিমান বিধ্বস্তের খবরে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে রাশিয়া ও ইউক্রেনের রাজনৈতিক সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টির আশঙ্কায় এশিয়ার বেশিরভাগ শেয়ার বাজারেই দর পড়েছে।

No comments:

Post a Comment