Saturday, July 19, 2014

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর স্বার্থে মাস্টার প্ল্যান পরিবর্তন:যুগান্তর

বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে পরিকল্পিত নগরায়নের ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অপরিকল্পিত নগরায়নের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রকৌশলীদের সতর্ক করেছেন। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোই প্রণীত নগর পরিকল্পনাকে তছনছ করে অপরিকল্পিত নগরায়নে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছে। আর তারা এসব বেআইনি কাজ করছে ক্ষমতার প্রভাব আর আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক
্ষ (আরডিএ) ক্ষমতাসীন এক প্রভাবশালী নেতার স্থাপনা নির্মাণে ২০ বছরব্যাপী গৃহীত নগর মহাপরিকল্পনা সংশোধন করেছে। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি অনেকটা গোপনেই সম্পন্ন করা হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ২০১১ সালের ১০ নভেম্বর রাজশাহীর চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার হাল দাগ নং-১৩৪৯, ১৩৫০, ১৩৫১ ও ১৩৫২-এর ওপর তার মালিকানাধীন বারিন্দ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমতি চেয়ে আরডিএ’র কাছে আবেদন করেন। বিষয়টি ওই বছরের ৩০ নভেম্বরের সাধারণ সভায় আলোচিত হয়। আরডিএ’র নগরপরিকল্পক ওই সভায় জানান, সংসদ সদস্য (তৎকালীন) শাহরিয়ার আলম যেখানে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ করতে চান সেটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। আরডিএ’র মহাপরিকল্পনায় এলাকাটি সুবজ জোন হিসেবে চিহ্নিত। হাসপাতাল রেড বা লাল শ্রেণীভুক্ত প্রতিষ্ঠান। সে ক্ষেত্রে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন ছাড়া প্রস্তাবিত এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়। আর ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করতে হলে মহাপরিকল্পনা সংশোধন করতে হবে। মহাপরিকল্পনা সংশোধন করা আরডিএ’র পক্ষেও সম্ভব নয়। সূত্রগুলো থেকে আরও জানা যায়, আরডিএ’র তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুুর রহিম চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার তার বিশেষ ক্ষমতাবলে মহাপরিকল্পনা সংশোধনের সুপারিশ করেন। চেয়ারম্যান তার সুপারিশ নোটে লেখেন, ‘নগর মহাপরিকল্পনা সংশোধনের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিবেচনার অনুরোধ করা হল।’ জানা যায়, শাহরিয়ার আলমের হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তনের জন্য আরডিএ একটি বিশেষ সুপারিশপত্র ২০১২ সালের প্রথম দিকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। স্পর্শকাতর এই বিষয়টি এক বছরেরও বেশি সময় মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি অবস্থায় ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের বিশেষ সুপারিশে মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন আরডিএ’র মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনের ফাইলটিতে স্বাক্ষর করেন। মন্ত্রণালয় ওই বছরে এপ্রিলে চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকায় শাহরিয়ার আলমের হাসপাতাল নির্মাণে মহাপরিকল্পনা সংশোধন করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। অভিযোগ রয়েছে কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ও জনমত গ্রহণ না করেই মহাপরিকল্পনা সংশোধনের প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়। এদিকে ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নাজিয়া ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে আরডিএর সুপারিশ ও ছাড়পত্র প্রদানের ফলে চন্দি মা আবাসিক এলাকার ভূমিকে মিশ্র শ্রেণী বিবেচনা ও ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করা হল। পাশাপাশি রাজশাহী মহানগরীর মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনে আরডিএর প্রস্তাব অনুমোদন করা হল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনের মাধ্যমে চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করে মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই বারিন্দ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। বর্তমানে সেখানে নির্মাণ কাজের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্যক্রমও চলছে। উল্লেখ্য, চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকাটি রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। পরিবেশ অধিদফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে মেডিকেল প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল হচ্ছে লাল শ্রেণীভুক্ত প্রতিষ্ঠান, যা কোনোভাবেই আবাসিক এলাকায় স্থাপনের অনুমতি দেয়ার সুযোগ নেই। আর এজন্য মহাপরিকল্পনা সংশোধন করাও পূর্ত আইনের স্পষ্ট লংঘন। এই কর্মকর্তার মতে, মহাপরিকল্পনা জাতীয় সংসদে পাস হয়ে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়। এই আইন লংঘন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে রাজশাহী মহানগরীর মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয় যার মেয়াদ রয়েছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। আরডিএর ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশের ১৬ ধারা মতে মাস্টারপ্ল্যান সংশোধন শুধু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে করা হয় এবং এতে এলাকাবাসীর আপত্তি গ্রহণ জরুরি যা এখানে করা হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আরডিএ’র নগরপরিকল্পক প্রকৌশলী আজমেরী আশরাফী যুগান্তরকে বলেন, আরডিএর সাধারণ সভার সিদ্ধান্তক্রমে আবাসিক এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণে মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনের অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয় অনুমতি দেয়ায় আমরা হাসপাতাল নির্মাণের ছাড়পত্র দিয়েছি। অনুরূপ ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকের জন্য কঠোরতা অবলম্বন করা হলেও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আরডিএর এই শিথিলতা কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে উনি প্রভাবশালী মানুষ। আমার পদাবস্থান থেকে আমি এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না। আবাসিক এলাকায় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপির বক্তব্য জানার জন্য শুক্রবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে তার সহকারী ব্যক্তিগত সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মন্ত্রীমহোদয় ব্যস্ত আছেন, এ বিষয়ে তিনি কথা বলবেন না।’ অভিযোগ রয়েছে, মাস্টারপ্ল্যানে জনসাধারণের ব্যবহার উপযোগী জায়গায় আরডিএ স্থাপনা নির্মাণের নকশা অনুমোদনসহ ছাড়পত্র প্রদান করে না। তবে আরডিএ এই কঠোরতা দেখান শুধু সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এরই মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য মাস্টারপ্ল্যান সংশোধন করেছে। এছাড়াও মহাপরিকল্পনায় খোলা জায়গা হিসেবে চিহ্নিত রাজশাহীর নিউমার্কেট সংলগ্ন এলাকায় সাবেক শিল্পপ্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী নির্মাণ করছেন বহুতলবিশিষ্ট শপিং কমপ্লেক্স। আরডিএ মহাপরিকল্পনা লংঘন করে তাকেও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের ছাড়পত্র দিয়েছে। অভিযোগে আরও জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীতে নকশা অনুমোদন ও ছাড়পত্র প্রদান ছাড়াই শত শত ভবন নির্মিত হয়েছে গত কয়েক বছরে। অভিযোগ হলেও আরডিএ ইমারত আইন লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। ফলে রাজশাহীতে বাড়ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন।  

No comments:

Post a Comment