Monday, July 21, 2014

হুন্ডির টাকা আত্মসাতের চেষ্টা:যুগান্তর

কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। তিনজন তিন ধরনের টাকার অংক বলছে। একজন বলছেন, টাকা ছিল ৭৯ লাখ। একজনের দাবি ৬৫ লাখ। পুলিশ বলছে, ৫৯ লাখ। তবে টাকার অংক যাই হোক না কেন, ৭ জুলাই রমনা থানা পুলিশ মোটা অংকের টাকা উদ্ধার করেছে। কিসের টাকা কোথা থেকে এলো এত টাকা, এর মালিকই বা কে- এ নিয়েই চারদিকে গুঞ্জন চলছে। আর এই ফাঁকে কৌশলে পুরো টাকা গায়েব করে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। টাকাসহ গ্রেফতারকৃত আসামি বলছেন, ‘৭
৯ লাখ টাকা হুন্ডির।’ পুলিশের দাবি ছিনতাই। টাকার মালিকানা দাবি করে যে মামলা হয়েছে সেখানেও বড় ধরনের অসঙ্গতি। মালিকের পরিচয় নিয়ে আছে সন্দেহ, সংশয়। গুজব আছে, রমনা ডিভিশনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা পুরো টাকা আত্মসাতের জন্য নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন। ‘হুন্ডি’র টাকা হওয়ায় প্রকৃত মালিক সামনে আসছেন না। ফলে পুরো টাকা আত্মসাতের জন্য নকল মালিক বানানোর নাটক সাজানো হয়েছে। টাকার মালিক সাজার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে দুজন। এরপর আবির্ভাব হয়েছে জিয়াউর রহমানের। টাকাসহ আটক লিটনের অভিযোগ, তার কাছ থেকে টাকার কার্টন কেড়ে নেয়ার পর থেকেই পুলিশ পুরো টাকা হজম করার ফন্দি আঁটতে থাকে। শুরুতেই দশ লাখ টাকা সরিয়ে ফেলে। ইস্কাটনের প্রত্যক্ষদর্শীরাও একই কথা বলেন। তাদের ভাষ্য কার্টন কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে পুলিশ। এরপর সেখান থেকে বেশ কয়েক বান্ডিল টাকা হাতিয়ে নেয় কর্তব্যরত পুলিশ। টাকার মালিকানার বিষয়ে জানতে চাইলে রমনা থানার ওসি মসিউর রহমান রোববার যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন। ইতিমধ্যে জিয়াউর রহমান নামের এক ব্যক্তি টাকার মালিকানা দাবি করে মামলা করেছেন। তিনি মালিকানার সপক্ষে কিছু প্রমাণপত্রও দিয়েছেন। এখন তদন্ত শেষেই বলা যাবে টাকাগুলোর মালিক তিনি নাকি টাকাগুলো ‘হুন্ডি’র মাধ্যমে পাচার করা হচ্ছিল। ওদিকে জিয়াউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, টাকাগুলো অবশ্যই তার। তিনি ব্যবসায়িক কাজে টাকাগুলো ব্যাংক থেকে তুলে ধানমণ্ডিতে পাঠাচ্ছিলেন। পথে টাকাসহ তার দুই কর্মচারী ছিনতাইয়ের শিকার হন। ৭ জুলাই রাজধানীর ইস্কাটন থেকে ছিনতাইকৃত ৫৯ লাখ টাকা উদ্ধার হওয়ার কথা জানায় পুলিশ। তবে সেদিন এ পরিমাণ টাকা ছিনতাই হওয়ার কোনো রেকর্ড রমনা থানায় নেই। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কোনো থানায়ই জিডি বা মামলা হয়নি। এরপরও পুলিশ উদ্ধারকৃত টাকাকে ছিনতাইয়ের বলে চালানোর চেষ্টা করছে। উদ্ধারকৃত টাকার সঙ্গে লিটন নামের এক গুলিবিদ্ধ যুবককে গ্রেফতার দেখানো হয়। শুরুতে উদ্ধারকৃত টাকার মালিক পাওয়া যাচ্ছিল না। ঘটনার একদিন পর জিয়াউর রহমান নামের এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি টাকার মালিক সেজে থানায় হাজির হয়ে টাকা দাবি করেন। গ্রেফতারকৃত লিটন ব্যক্তিগত জীবনে অটোমোবাইলের ঝালাই মিস্ত্রি। হুন্ডি সোর্স মনিরও এক সময় একই কাজ করত। সেখান থেকেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা। যা বলল আহত লিটন : ঘটনার দিন টাকাসহ গ্রেফতারকৃত লিটন এখন পঙ্গু হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন। তার একটা পা কেটে ফেলা হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার দুপুরে যুগান্তরের কাছে ঘটনার আদ্যপান্ত খুলে বলেন লিটন। তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে মনির নামের এক হুন্ডি সোর্স তাকে বলছিল, ‘একটা এমএম (হুন্ডির টাকার সাংকেতিক নাম) ধরার কাজ করলে মোটা অংকের টাকা পাওয়া যাবে।’ কিন্তু তিনি এ কাজে রাজি হচ্ছিলেন না। ৬ জুলাই মনির তার দোকানে এসে বলেন, ‘কাইল বড় একটা হুন্ডির টাকা বাংলামোটর দিয়া পার হইব। ঠ্যাক দিতে পারলে আর চিন্তা নাই।’ তার কথায় লোভে পড়ে হুন্ডির টাকা ধরার জন্য লিটন তার দুই বন্ধু কামাল ও ছোট লিটনকে সঙ্গে নিয়ে বাংলামোটরের তিনটি পয়েন্টে অবস্থান নেন। লিটন বলেন, ‘বইয়া থাকতে থাকতে রাইত ৮টার দিকে ওগো (হুন্ডি পাচারকারী) হোন্ডাতে দু’জন আইতে দেখলাম।’ আমরা তিনজনও একটা হোন্ডায় কইরা ওগো পিছু লই। লিটনের ভাষ্যমতে, বাংলামোটর হেলেনা সেন্টারের কাছে মিলনের ভাঙ্গারি দোকানের সামনে হুন্ডির টাকা বহনকারীদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করেন তারা। তাদের কাছে তথ্য ছিল টাকা রয়েছে মোট এক কোটি ২০ লাখ। লিটন বলেন, ‘ওগোর মোটরসাইকেলে টাকা ভর্তি দুইটা কার্টন আছিল। আমরা একটা কার্টন লওনের পর অন্য কার্টনটা নিয়াই ওরা ভাইগ্যা যাইতে পারসে।’ লিটন জানান, টাকার কার্টন ছিনিয়ে নেয়ার সময় কিছু লোক ঘটনা দেখে ফেলে। কয়েকজন তার পিছু নেয়। লোকজন এড়াতে লিটন টাকার কার্টন নিয়ে বাংলামোটরের ড্রাগন বারের গলিতে ঢুকে পড়েন। কিন্তু সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় সাদা পোশাকে থাকা রমনা থানার এক এসআই ইফতেখার মোহাম্মদ আল আমিন তাকে থামান। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে এসআই ইফতেখার তার মাথায় হেলমেট দিয়ে বাড়ি দেন। এতে তার হাত থেকে টাকার কার্টনটি পড়ে যায়। এরপর এসআই ইফতেখার ও তার সঙ্গে থাকা আরও দুই পুলিশ সদস্য টাকার কার্টনটি কেড়ে নেন। কার্টন খুলে অনেক টাকা দেখতে পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে রমনা থানার ওসিকে ফোন করেন তারা। ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওসি একটি টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসেন। ঘটনাস্থলেই আলাদা করা হয় ১০ লাখ : ঘটনার দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, হুন্ডির টাকা লুট হওয়ার খবর পেয়ে তারাসহ আশপাশের ব্যবসায়ীরা ঘটনাস্থলে জড়ো হন। তখন টাকাসহ গ্রেফতারকৃত এক যুবককে মারধর করছিল পুলিশ। কয়েকজনকে সাক্ষী করে পুলিশ সেখানেই টাকা গোনা শুরু করে। টাকা গুনে পুলিশ তাদের জানান, টাকা আছে ৫৯ লাখ। তবে গ্রেফতারকৃত লিটন বলেন, তাকে আটক করার পর কার্টন ছিঁড়ে টাকা গুনে ৬৯ লাখ টাকার কথা ওসিকে জানায় পুলিশ। ওসি আসার পর তাকেসহ টাকার কার্টন গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িতে তোলার সময় ওসি দারোগাকে ১০ লাখ টাকা আলাদা একটি প্যাকেটে ভরে রাখতে বলেন। এরপর ওসি লিটনকে বলেন, ‘কেউ জানতে চাইলে বলবি টাকা ছিল ৫৯ লাখ।’ অবশ্য লিটনের কাছে কেউ কখনোই টাকার অংক জানতে চায়নি। টাকার মালিক দাবিদার জিয়াউর রহমান ৬৫ লাখের দাবিতে মামলা করলে প্রকৃত অংক নিয়ে আবারও বিতর্ক ওঠে। ফলে আগের ১০ লাখ টাকার বিতর্ক চাপা পড়ে ৬ লাখ টাকার বিতর্ক তৈরি হয়। এই ৬ লাখ টাকার বিষয়ে সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রমনা থানার ওসি মসিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অভিযান চালানোর সময় ধস্তাধস্তিতে ওই টাকা কোথাও পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। মামলার বাদী জিয়াউর রহমান ৬৫ লাখ টাকা দাবি করে মামলা করলেও এর সপক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। তিনি টাকার মালিকানা প্রমাণ করতে ৭ জুলাই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৪৭ লাখ টাকা উঠানোর কাগজপত্র থানায় জমা দিয়েছেন। বাকি ১৮ লাখ টাকার কোনো প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। ফলে টাকার প্রকৃত অংক ও মালিক নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। রমনা থানার একটি সূত্র জানায়, টাকা উদ্ধারের পর আরও দুই ব্যক্তিকে টাকার মালিক সাজানোর চেষ্টা করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, পুরো টাকা আত্মসাতের জন্য নানা ধরনের নাটক সাজানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। যেভাবে পায়ে গুলি : হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লিটন বলেন, ওসি আসার পর তাকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়। এরপর তাকে হেয়ার রোডে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের কাছে গাড়ি থেকে নামায় পুলিশ। এরপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুলিশ লিটনের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে তিনটি গুলি করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় লিটনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। লিটন বলেন, ‘হাসপাতালে অনেক সাংবাদিক আইসা পড়ল। তখন ওসি স্যার কইল খবরদার সাংবাদিক গো কাছে কিছু কইলে তোরে জানে মাইরা ফালামু।’ ঢাকা মেডিকেলে দু’দিন ভর্তি থাকার পর লিটনকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। ক্ষতস্থানে সংক্রমণের কারণে পঙ্গু হাসপাতালে লিটনের একটা পা কেটে ফেলে দেন চিকিৎসকরা। লিটন বলেন, ‘আমি অপরাধী। হুন্ডির টাকা লুট করতে গেছিলাম। কিন্তু তাই বইল্যা কি পুলিশ আমারে গুলি কইরা পঙ্গু বানাইব। আমারে জেলে পাঠাইত। বিচার করত। কিন্তু পঙ্গু কইরা দিল। এখন আমি ক্যামনে সংসার চালামু।’ ঘটনার পুলিশি বর্ণনা : থানা পুলিশ জানিয়েছে, ৭ জুলাই ঘটনার দিন রমনা থানার এসআই মনিরুজ্জামান, ইফতেখার মোহাম্মদ আল আমিন, এএসআই শাজাহান ও এএসআই আলমগীরসহ একটি দল মোটরসাইকেলে মোবাইল ডিউটিতে ছিলেন। ডিউটিরত অবস্থায় রাত সোয়া ৮টার দিকে তারা ইস্কাটন রোডে ছিনতাইয়ের ঘটনা দেখতে পান। এসআই ইফতেখার মোহাম্মদ আলামিন যুগান্তরকে বলেন, ‘দেখলাম ছিনতাই হচ্ছে। সেখানে একটা-দুটো গুলির শব্দ পেলাম। এরপর দেখলাম ধস্তাধস্তি হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটি জানিয়ে ওয়্যারলেসে ওসিকে বার্তা পাঠালাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ওসি স্যার এসে পড়েন। ওসি এলে তারাও ছিনতাইকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালান। একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ ‘ছিনতাইকারী’ লিটনকে টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে ৫৯ লাখ টাকা উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান তারা। ইফতেখার দাবি করেন যখন তারা টাকা ভর্তি কার্টনটি উদ্ধার করেন তখন কার্টনটি ছেঁড়াই ছিল। রহস্যজনক এজাহার : ৭ জুলাই ঘটনার দিন রাত ১টায় রমনা থানার ওসি মসিউর রহমান যুগান্তরকে বলেছিলেন, উদ্ধারকৃত টাকার কোনো মালিক পাওয়া যায়নি। অবশ্য পরদিনই চিত্র পাল্টে যায়। জিয়াউর রহমান নামের এক ব্যক্তি টাকার মালিক দাবি করে ৮ জুলাই মামলা করেন। কিন্তু মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে বড় ধরনের ফাঁক পাওয়া গেছে। এজাহারে বলা হয়েছে, গত তিন জুলাই জিয়াউর রহমান তার দু’জন কর্মচারীকে ইস্কাটন থেকে ৬৫ লাখ টাকা কার্টনে ভরে ধানমণ্ডিতে তার ব্যবসায়িক পার্টনারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পথে তারা ছিনতাইয়ের শিকার হন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন ছিনতাই হওয়া ৬৫ লাখ টাকার মধ্যে ৪৭ লাখ টাকা ৭ জুলাই তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে তোলা হয়েছে। বাকি ১৮ লাখ টাকা ব্যবসায়িকভাবে সংগ্রহ করা। অর্থাৎ এজাহার অনুযায়ী তিন জুলাই টাকা নিয়ে তার কর্মচারীরা ইস্কাটন থেকে বের হন। চার দিন পর আবার ৭ জুলাইতেই ইস্কাটনেই ছিনতাইয়ের শিকার হন। এজাহারে এতবড় অসঙ্গতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মামলার বাদী জিয়াউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এজাহারে অসাবধানতাবশত এই ভুলটা হয়ে গেছে। এটি সংশোধনের জন্য দরখাস্ত দিয়েছে তার আইনজীবী। সূত্র জানায়, মামলার বাদী জিয়াউর রহমান ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিক। বাংলাদেশে তিনি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। অবশ্য জিয়াউর রহমান নিজেকে বাংলাদেশী নাগরিক বলে দাবি করেছেন। নাগরিকত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জিয়াউর রহমান কিছুটা হিন্দি উচ্চারণে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের নাগরিক আছি। লেকিন (কিন্তু) আমার বাপ-দাদা সব ভারতের লোক আছে।’ তিনি নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচয় করাতে একটি সংবাদপত্রের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে তার সখ্যের কথা বলেন। মামলার বাদী জিয়াউর রহমানের নাগরিকত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে রমনা থানার ওসি মসিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তিনি ভারতের নাগরিক। কিন্তু ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে আছেন।  

No comments:

Post a Comment