Tuesday, July 22, 2014

ঝুঁকি নিয়ে ঈদ আনন্দযাত্রা:যুগান্তর

আসন্ন ঈদে বর্ষা মৌসুমে অশান্ত নৌপথে ঝুঁকি, বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি মাথায় নিয়েই ঘরমুখো হচ্ছেন যাত্রীরা। যে কোনোভাবেই হোক ঈদে বাড়ি ফিরতে চায় সবাই। এই সুযোগ নেয় অসাধু লঞ্চ মালিকরা। অন্যান্যবারের মতো এবারও বিভিন্ন রুটে নামানো হয়েছে রঙচঙ ও জোড়াতালি দেয়া ত্র“টিপূর্ণ ফিটনেসের অসংখ্য নৌযান। লঞ্চগুলোতে নেই পর্যাপ্ত জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামাদি। ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর বাসিন্দাদের চলাচলে এ
সব যানবাহনই অন্যতম ভরসা। এছাড়া পদ্মায় মাওয়া-কাওড়াকান্দি ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পারাপার এবং রাঙ্গামাটি ও হাওর এলাকায়ও চলাচল করছে অনেক পুরনো ও জীর্ণশীর্ণ লঞ্চ। সম্প্রতি একই মাসে দুটি ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনার পরও এসব লঞ্চের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি লঞ্চ মালিক ও প্রশাসন। দুর্ভোগের চিত্র এখানে শেষ নয়। ঢাকা নদীবন্দরসহ (সদরঘাট) অন্য নৌবন্দরগুলোতে যাত্রী হয়রানি চলছে। ঈদ সামনে রেখে বেড়েছে হকার, পকেটমার, ছিনতাইকারী ও অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের আনাগোনা। প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিনিয়ত এসব কর্মকাণ্ড হলেও নেই প্রতিকার। প্রতিনিয়ত যাত্রীরা হয়রানির শিকার হলেও দেখার কেউ নেই। এদিকে ঈদের আগমুহূর্তে সদরঘাট টার্মিনাল ভবনে প্রবেশ ফি বাড়িয়েছে কর্তৃপক্ষ। টার্মিনাল ভবনে প্রতিবার প্রবেশের জন্য মাথাপিছু চার টাকার জায়গায় ৫ টাকা গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। প্রতিবার ঈদে ‘ভরে গেলে ছেড়ে যাবে’ এমন নীতিতে লঞ্চ ছাড়তে বাধ্য করতেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এবার লঞ্চ মালিকদের দাবির মুুখে ওই নিয়ম পরিবর্তন করে ইচ্ছেমতো লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এ ঈদে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই না হওয়া পর্যন্ত লঞ্চ ছাড়বেন না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন লঞ্চ মালিক নেতারা। সবমিলিয়ে নৌপথে ঝুঁকির মধ্যে ঈদ আনন্দযাত্রা হবে বলে আশঙ্কা করছেন যাত্রীরা। তবে নৌমন্ত্রী মোঃ শাজাহান খান যুগান্তরকে বলেছেন, ঈদে আবহাওয়া পূর্বাভাস জেনে লঞ্চ ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। লঞ্চগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, লাইফ জ্যাকেট ও বয়া রাখতে বলা হয়েছে। ঈদে লোডলাইন (লঞ্চের নির্দিষ্ট সীমানা) ক্রস করার আগেই লঞ্চ ছাড়তে বাধ্য করা হবে। এজন্য নদীবন্দরে বিআইডব্লিউটিএ, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, নৌপুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ড সদস্য মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা নদীবন্দর থেকে লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার পর পথে যাত্রী তুলতে দেয়া হবে না। চাঁদপুর থেকে অতিরিক্ত লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কারও গাফিলতি সহ্য করা হবে না। বিআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ছোট-বড় লঞ্চের সংখ্যা প্রায় ৮৫০টি। এর মধ্যে বড় আকারের লঞ্চ ২৫০টি। বাকি ৬০০ লঞ্চ ছোট আকারের। বড় লঞ্চগুলোর বেশির ভাগই ২০০৪ সাল ও পরবর্তী সময়ে তৈরি করা হয়েছে। ছোট লঞ্চগুলোর অধিকাংশ ১৯৯৫ সালের পরবর্তী সময়ে তৈরি। এ হিসাবে বড় লঞ্চের বয়স ১০ বছর ও ছোট লঞ্চের বয়স ২০ বছর। সাম্প্রতিক সময়ে বড় ১৬টিসহ কিছু ছোট লঞ্চ নেমেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে ৮৫০টি লঞ্চের ফিটনেস সার্ভে করেন চারজন সার্ভেয়ার। তাদের কেউ কেউ লঞ্চ পরিদর্শন না করে অফিসে বসেই সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে এ ধরনের ত্র“টিপূর্ণ নৌযানকেও ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার পর তদন্তে ফিটনেস ত্র“টি ও অনিয়মের খবর বেরিয়ে এসেছে। সম্প্রতি ডুবে যাওয়া এমভি শাথীল ও এমভি মিরাজ লঞ্চেও ত্র“টি ধরা পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে পদ্মা ও মেঘনার মতো উত্তাল নদীতে এসব ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ যাত্রী বহনে ব্যবহার করছেন মালিকরা। ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও আশপাশ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঈদে যাত্রী বহনে ছোট-বড় লঞ্চে জোড়াতালি দিয়ে ত্র“টি সারানোর কাজ চলছে। এসব নৌযানে রং দিয়ে নতুন করার চেষ্টা চলছে। ডকইয়ার্ডের শ্রমিকরা জানান, ঈদ এলেই পুরনো লঞ্চে জোড়াতালি শুরু হয়। বেশির ভাগ লঞ্চ এত পুরনো যে, নতুন স্টিলের ব্লেড ঝালাই করে লাগানোর সময় অন্য প্লেটগুলো নষ্ট হয়ে যায়। হাতুড়ির আঘাতে নৌযানের স্ট্রাকচার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঈদে এসব নৌযানে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তারা। তবে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ ঈদে চলাচল করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমোডর জাকিউর রহমান ভূঁইয়া। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঈদে প্রতিকূল আবহাওয়ায় সতর্কতার সঙ্গে নৌযান চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফিটনেস ও সার্ভে সার্টিফিকেট নেই এমন নৌযান যাতে চলাচল করতে না পারে সেজন্য সার্ভেয়ার, ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সার্ভেয়ার সঙ্কট থাকায় নৌযান যথাযথভাবে সার্ভে করতে সমস্যা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি ডুবে যাওয়া দুটি লঞ্চেরই নকশায় ত্রুটি ছিল। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নৌপথের যাত্রীদের আরও কয়েক ধাপে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের লঞ্চে ওঠার একমাত্র মাধ্যম সদরঘাট এখন আতংকের এক নাম। সরেজমিন দেখা গেছে, ঈদ সামনে রেখে এ নদীবন্দরে চরম স্বেচ্ছচারিতা ও অনিয়ম শুরু হয়েছে। টার্মিনালে মাল বহনে কুলি-মজুরদের চাহিদামতো টাকা না দিলেই মালামাল টানাহেঁচড়াসহ যাত্রীদের লাঞ্ছিত ও মারধর করা হচ্ছে। এছাড়া সদরঘাটে যাতায়াতের রাস্তায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। হকারদের দখলে চলে গেছে ফুটপাত। হেঁটে যাত্রীরা সদরঘাট যাবেন এমন উপায় নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় মাস্তানদের ম্যানেজ করে নিয়মনীতির উপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোরে অসংখ্য গাড়ি সদরঘাট টার্মিনাল পর্যন্ত ঢুকে গিয়ে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি করছে। এসব বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. শামছুদ্দোহা খন্দকার বলেন, যাত্রী সুবিধার্থে সদরঘাটে নিজস্ব কুলি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ব্যাগ-লাগেজ বহনে সরকার নির্ধারিত ১০ টাকার বেশি কোনো যাত্রী থেকে আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিআইডব্লিউটিএর বন্দর কর্মকর্তারা জানান, সদরঘাটে যাত্রী হয়রানি বন্ধে ‘শ্রম যার, মজুরি তার’ নীতিতে ইজারামুক্ত করা হয়েছে। কোনো যাত্রী নিজ হাতে লাগেজ বহন করলে কোনো টাকা দিতে হয় না। সরেজমিন উল্টো চিত্র দেখা গেছে। কুলি-মজুরদের টাকা না দিয়ে যাত্রীরা মাল নিতে পারেন না। এমনকি লঞ্চ মালিকদের স্বজনরাও হয়রানির শিকার হয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন লঞ্চ মালিক জানান, তার এক নিকট-আত্মীয় নিজ হাতে পাখির খাঁচা নিয়ে লঞ্চে ওঠার সময় বাধা দেয় কুলি-মজুররা। তারা জোরপূর্বক ওই খাঁচা লঞ্চে তুলে দিতে ৩০০ টাকা দাবি করে। ওই লঞ্চ মালিক ফোনে কুলিদের সঙ্গে কথা বলার পরও টাকা দেয়া থেকে রেহাই পাননি তার আত্মীয়। অপর এক লঞ্চ মালিক জানান, সৌদি আরব থেকে আসা তার এক নিকটাত্মীয়র লাগেজ লঞ্চে তুলে দিতে ৮ হাজার টাকা দাবি করে কুলি-মজুররা। অনেক দেনদরবার করে ৮ হাজার টাকার পরিবর্তে ১ হাজার টাকায় রফা করতে সমর্থ হন তিনি। সরেজমিন সদরঘাট ঘুরে দেখা গেছে আরও ভয়াবহ চিত্র। যাত্রীরা সদরঘাট পৌঁছলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে শ্রমিকরা। হাতে বহনযোগ্য ব্যাগ এসব কুলি-মজুর দিয়ে বহন করতে বাধ্য করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে যাত্রীদের মারধর করতে দেখা গেছে। পটুয়াখালীগামী এক যাত্রীর ব্যাগ ২০ টাকায় বহন করার কথা বলে লঞ্চে গিয়ে ৩০০ টাকা আদায় করতে দেখা গেছে। ওই যাত্রী বাড়তি টাকা দিতে না চাইলে শ্রমিকরা জড়ো হয়ে তাকে হেনস্থা করতে দেখা গেছে।  

No comments:

Post a Comment