Sunday, August 31, 2014

বৈধ গ্যাস সংযোগে অবৈধ হস্তক্ষেপ:কালের কন্ঠ

সরকারের নিয়ম অনুযায়ী চাহিদাপত্র (ডিমান্ড নোট) জমা দিয়েই গ্যাস সংযোগ পেয়েছেন তাঁরা। প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে গ্যাসের বিলও ব্যাংকে জমা দিয়ে যাচ্ছেন। চার বছর ধরে এসব সংযোগ নিয়ে গ্রাহকরা বাসাবাড়িতে গ্যাস ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু গত মাসে হুট করে এসব সংযোগ ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে তা বিচ্ছিন্ন করার তাড়জোড় শুরু করে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। রীতিমতো তালিকা করে অনেকের গ্যাস সংযোগ ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অন
েকেরটা যেকোনো মুহূর্তে কাটার পাঁয়তারা চলছে। এ নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ, হতাশা আর আতঙ্ক বিরাজ করছে হাজারো মানুষের মধ্যে। তাদের অভিযোগ, এসব অঞ্চলের গ্যাস সংযোগ বিতরণী সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ঘুষ আদায়ের নীলনকশা করতেই শুরু করেছেন গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান। তা ছাড়া পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানি লিমিটেডের দুই কর্মকর্তার বিরোধের শিকারও হচ্ছে অনেকে। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, ঢাকার কেরানীগঞ্জে চলছে এই কথিত অভিযান। ফলে এসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ পড়েছে বিপাকে, ফুঁসে উঠছে ক্ষোভে। এ কারণে কথিত অবৈধ গ্যাস সংযোগ কাটতে গিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়ছে কর্তৃপক্ষ। সংযোগ না কেটেই অনেক জায়গা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে তাদের। সাধারণ মানুষের দাবি, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গ্যাসের যে সংযোগ পেয়েছে তারা, সেগুলো না কেটে পেট্রোবাংলা বৈধ করার সুযোগ করে দিক। এর আগে পেট্রোবাংলা এক দফা অবৈধ গ্যাস সংযোগ বৈধ করার জন্য গত বছরের ২০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে ৭০ হাজার অবৈধ সংযোগ নেওয়া গ্রাহক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিয়ে বৈধ হন। কিন্তু সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চলে বৈধভাবে সংযোগ নেওয়া গ্রাহকরা পড়েছেন বিপাকে। গ্রাহকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল) কর্তৃপক্ষ সংযোগ এলাকা জরিপ করে গ্রাহকদের নামে ডিমান্ড নোট ইস্যু করে। স্থানীয় ব্যাংকে ডিমান্ড নোটের টাকা পরিশোধের পর গ্যাস বিতরণী কম্পানির কর্মকর্তারা কয়েকবার সরেজমিন পরিদর্শন করে সংযোগ প্রদান করেন। সংযোগ পাওয়ার পর থেকে গ্রাহকরা নিয়মিত গ্যাস বিল পরিশোধ করে আসছিলেন। কিন্তু মাসখানেক আগে তিতাস ও পিজিসিএলের ভ্রাম্যমাণ দল তাঁদের সংযোগগুলো অবৈধ আখ্যা দিয়ে তা বিচ্ছিন্ন করা শুরু করে। পিজিসিএলের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের বিরুদ্ধে দুই ধরনের অভিযোগ তোলা হয়। এর একটি হলো- সংযোগগুলো সরবরাহ লাইন থেকে ৫০ মিটারের বেশি দূরত্বে অবস্থিত; দ্বিতীয়টি হলো- কোনো কোনো সংযোগ নেওয়া হয়েছে পৌনে এক ইঞ্চি পাইপলাইন থেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাঁরা অবৈধ উপায়ে গ্যাসের সংযোগ নিয়েছেন সেসব লাইন উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। কারণ এসব লাইনের জন্য খুবই নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায়িত্ব তখন কে নেবে?’ ৫০ মিটার পাইপলাইনের দূরত্বে অনেকে বৈধভাবেই সংযোগ নিয়েছেন কিন্তু এখন দূরত্বের কথা বলে তাঁদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে- এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর বলেন, ‘এটা এককথায় অসম্ভব। যাঁরা ডিমান্ড নোট দিয়েছেন, সরকারি নিয়ম মেনে গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করছেন, নিয়মিত বিল দিচ্ছেন, তাঁদের সংযোগ কোন যুক্তিতে কাটা হবে? পাইপলাইনের ৫০ মিটার বাইরে কোনো গ্রাহককে যদি সংযোগ দেওয়াও হয়, তাহলেও তার লাইন কাটার সুযোগ নেই। তবে নতুন করে আর কাউকে ৫০ মিটারের বাইরে সংযোগ দেওয়া হবে না। কিন্তু পুরনোদের সংযোগ কাটা যাবে না।’ সংযোগ কাটার নামে দুর্নীতির ফন্দির বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি কেউ সংযোগ কাটার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করতে চায়, পেট্রোবাংলা তাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেবে। এখানে জনস্বার্থ জড়িত।’ কোনোভাবেই জনস্বার্থ বিঘ্নিত করা যাবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। দুই এলাকায় দুই চিত্র : অনুসন্ধানে জানা যায়, অবৈধ পথে গ্যাস সংযোগ নিয়েছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর হাজার হাজার গ্রাহক। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও তিতাসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। বিদ্যুতের তারের মতো গাছপালার ওপর দিয়েও নিম্নমানের পাইপ দিয়ে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব গ্যাসলাইন নিয়ে অনেকে আতঙ্কে রয়েছেন। এর তদারকি করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। শম্ভুপুরা, নোয়াগাঁও ও সনমান্দি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে গ্যাস সংযোগের নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে গ্যাস দালালরা। জানা গেছে, গত মহাজোট সরকারের সোনারগাঁ আসনের সাবেক এমপি আবদুল্লাহ আল কায়সার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির লিয়াকত হোসেন খোকা এসব অবৈধ সংযোগ বৈধ করার জন্য নেতা-কর্মীদের আশ্বস্ত করছেন। বর্তমান সংসদ সদস্যের নির্দেশেও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শত শত অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। সম্প্রতি স্থানীয় একটি অনুষ্ঠানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে আবার অভিযান চালানো হলে সংসদীয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করার হুমকি দিয়েছেন জাতীয় পার্টির এই এমপি। তিনি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য। অভিযানের বিরুদ্ধে রাজপথে নামারও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এলে তা প্রতিহত করার হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আসুক, এবার দেখি কে গ্যাস সংযোগ কাটতে আসে। আমি আপনাদের সঙ্গে থেকে রাজপথে আন্দোলনে নামব। জনগণের আন্দোলনের মুখে কিছুই টিকবে না।’ অবৈধ গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে লিয়াকত হোসেন খোকা নিজের যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, এলাকাবাসীর দুর্ভোগ লাঘবের কথা বিবেচনা করে গ্যাস সংযোগ বৈধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চলে ঘটেছে এর উল্টো। সেখানে বৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নেওয়া গ্রাহকরা সংযোগ বিচ্ছিন্নের কোপানলে পড়েছে। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটা এলাকার মো. রাকিব বলেন, ‘বৈধভাবে সংযোগ নিয়ে প্রায় চার বছর ধরে আমরা গ্যাস ব্যবহার করে আসছি। ব্যাংকের মাধ্যমে গ্যাসের বিল সঠিক সময়েই পরিশোধ করেছি। অথচ আমাদের বৈধভাবে নেওয়া সংযোগকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আমাদের।’ পাবনার বেড়ার আবাসিক গ্রাহক অনিমেষ দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি ডিমান্ড নোট দিয়ে সরকারি সব নিয়ম মেনেই সংযোগ পেয়েছি। প্রায় এক বছর ব্যবহারও করছি। প্রতি মাসে বেড়া শাখার জনতা ব্যাংকে বিল জমা দিচ্ছি। আগস্ট মাসেও জুলাই মাসের বিল পরিশোধ করেছি। এখন শুনতে পাচ্ছি, আমার সংযোগটি পিজিসিএল কর্তৃপক্ষ বিচ্ছিন্ন করার তালিকা করেছে। যেকোনো মুহূর্তে তারা সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করতে পারে বলে আতঙ্কে আছি।’ জানা গেছে, বেড়ার মৈত্রবাঁধা, নাজিমবাজারের পিজিসিএলের আবাসিক গ্রাহক অনিমেষ দত্ত, যাঁর গ্রাহক সংকেত নম্বর ০৭০১০১২২৪; অঞ্জন রাহা, গ্রাহক সংকেত নম্বর ০৭০১০১২১১-  তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে মূল গ্যাসের পাইপলাইন থেকে তাঁদের সংযোগের দূরত্ব ৫০ মিটারের কিছু বেশি হওয়ায় লাইনটি কাটা হবে। কিন্তু সংযোগ দেওয়ার সময় পিজিসিএলের এ নিয়ম ছিল না। এ নিয়ম সদ্য চালু করা হয়েছে। অঞ্জন রাহা, অনিমেষ দত্তের মতোই বেকায়দায় পড়েছেন একই উপজেলার অনেকে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার শেরখালী মহল্লার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, ২০০৮ সালে তিনি তাঁর বাড়িতে গ্যাস সংযোগ নেন। পিজিসিএল কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা ডিমান্ড নোটের টাকা ব্যাংকে জমাসহ সব নিয়ম মেনেই তিনি গ্যাস সংযোগ পেয়েছিলেন। ছয় বছর ধরে তিনি নিয়মিত গ্যাসের বিলও পরিশোধ করেছেন। অথচ রোজার মধ্যে কর্তৃপক্ষ তাঁর গ্যাস সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে। একই মহল্লার মো. সিয়াম আলী ও সবুজ হোসেন রাজাও বললেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী মানুষ। অফিসের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে তাঁদের নিয়ম মেনেই সংযোগ নিয়েছিলাম। গ্যাস কম্পানি আমাদের সংযোগ দিলেও ছয় বছর পর আমরা জানতে পারলাম, আমাদের সংযোগটি নাকি অবৈধ। কী কারণে সংযোগটি অবৈধ হলো কিংবা এর জন্য দায়ী কারা, তা কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায়নি।’ দীর্ঘদিন গ্যাস ব্যবহারে অভ্যস্ত গৃহবধূ শাহিদা খাতুন বললেন, ‘গ্যাসলাইন কেটে দেওয়ার পর কী কষ্ট করে যে রান্নাবান্নার কাজ করছি তা একমাত্র আমি আর আল্লাহ তায়ালা জানেন।’ কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব, নেপথ্যে ঘুষ : পিজিসিএলের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণেই এসব অঞ্চলের বৈধ গ্রাহকদের সংযোগ বিচ্ছিন্নের তালিকা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সবচেয়ে দীর্ঘ তালিকা করা হয়েছে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী কার্যালয়ের আওতাধীন গ্রাহকদের। এ সংযোগগুলো দেওয়া হয়েছিল কার্যালয়ের তৎকালীন ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমানের আমলে। মাস ছয়েক আগে তাঁকে বগুড়া কার্যালয়ে বদলি করা হয়। এখান থেকেও আমিনুর রহমানকে শাস্তিমূলক বদলি করে সম্প্রতি পিজিসিএলের প্রধান কার্যালয় সিরাজগঞ্জের নকলায় নিয়ে আসা হয়েছে; আর তাঁর স্থানে আনা হয়েছে গোলাম মোর্শেদকে। আমিনুর রহমানের সময়কালের দেওয়া গ্যাসসংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গঠন করা হয়েছে গোলাম মোর্শেদের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমাণ টিম। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এই টিম বৈধ সংযোগ পাওয়া গ্রাহকের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। যারা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার তালিকা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ টিমের যুক্তি, পাইপলাইন থেকে যাদের সংযোগ ৫০ মিটারের বেশি, তাদের লাইন কাটতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভ্রাম্যমাণ দলের প্রধান গোলাম মোর্শেদ বলেন, ‘আমিনুর রহমান সাহেবের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। এটা নিছক গুজব। বিগত সময়ে যেসব গ্রাহকের নামে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল, শুধু সেগুলোর সংযোগই বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।’ বাঘাবাড়ী বিক্রয় কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক জহুরুল হক বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ দল বিচ্ছিন্ন করার সুপারিশ করায় ২৩টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আরো বিচ্ছিন্ন করা হবে যেসব সংযোগ, তার একটি তালিকা আমরা পেয়েছি। এসব সংযোগ কিভাবে পুনরায় দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে সুপারিশমালা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পেশ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। বক্তব্য নেওয়ার জন্য গতকাল শনিবার পিজিসিএলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রেজাউল ইসলামের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে বারবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। (প্রতিবেদনটির জন্য কালের কণ্ঠের পাবনা প্রতিনিধি  আহমেদুল হক রানা ও সোনারগাঁ প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান নুর তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন)।

No comments:

Post a Comment