বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ার পর গতকাল শনিবার এক দিনে পাঁচ জেলার ৮৩টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে ৩৫টি, গাইবান্ধায় ১০টি, বগুড়ায় ১৩টি, শেরপুরে ১০টি ও মুন্সীগঞ্জে ১৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও সিরাজগঞ্জেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। আর বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ পানির তোড়ে আরো বড় হচ্ছ
ে। অনেকের ঘরের চালা পর্যন্ত ডুবে যাওয়ায় খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে তারা। দুই দিন হয়ে গেছে এখনো বেশির ভাগ মানুষ ত্রাণের মুখ দেখেনি। এ ছাড়া তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, ঘাঘট, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, যমুনা ও পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহে কোনো কোনো জেলায় সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলেও গতকাল পর্যন্ত বিপৎসীমান অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এরই মধ্যে বন্যার পানি নামার প্রধান নদী মেঘনার চাঁদপুর অংশে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ- সারিয়াকান্দিতে ধনী-গরিব সবাই নিঃস্ব : সরেজমিনে দেখা গেছে, রৌহদহ গ্রামে ভেঙে যাওয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একটি অংশে পলিথিন ও পাটখড়ি দিয়ে তৈরি ঘরে শুয়ে আছেন আশি বছর পেরোনো বৃদ্ধ কছর উদ্দিন। বললেন, ‘সেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাত ভাত খাছি। এরপর আর পেটোত দানাপানি পরেনি। আজ সকালে একজনের কাছ থ্যাকা চারডা চিঁড়া চ্যানা আনা খাছি। সারাডা দিন গেল এক সের চালও পানু না। মনে হয় আজ আতোত না খায়্যা থাকা লাগবি।’ পাশের ঘরে একই এলাকার সত্তরোর্ধ্ব ময়না বেগম বললেন, ‘দুই দিন হলো কতো ম্যানষোক কারুবারু করনু কিন্তু কেউ এ্যানা সাহায্য দিলো না। বুড়ো মানুষ দৌড়াবার পারি না। এহন কুটি যাই, কী খাই!’ কথাগুলো বলার সময় তাঁর দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। শুধু কছর উদ্দিন কিংবা ময়না বেগম নন, বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ১১টি ইউনিয়নসহ ধুনট, সোনাতলা ও গাবতলী উপজেলার নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৩০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের বন্যা দুর্গতদের অবস্থা ঠিক এ রকমই। গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত সবাই এখন নিঃস্ব। যমুনার পানি এখনো বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল রৌহদহ পয়েন্টে ভেঙে যাওয়া বাঁধের মুখ বড় হয়ে ৮০০ মিটারে দাঁড়িয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার জানান, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে পানি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা গ্রামের কুলসুম (৩৭), রহিমা (৪০) ও মেহেরজান (৩৮) জানান, তাঁদের গ্রামের ১৫৭টি পরিবার দুই দিন ধরে বুক সমান পানির মধ্যে চৌকি, মাচা ও নৌকার ওপর পরিবার নিয়ে দিন-রাত কাটায়। গতকাল সকালে একটি নৌকা এলে তাতে চড়ে তারা বাঁধের ওপরে গাদাগাদি করে আশ্রয় নেয়। রৌহদহ গ্রামের আশপাশে আবাদি জমির মধ্যে এখন অথৈ পানি। নৌকা নিয়ে ডুবে যাওয়া এসব এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বসতবাড়ির ঘরের টুই (চালা) পর্যন্ত পানি উঠেছে। ডুবে গেছে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কোমর সমান পানি পর্যন্ত এসব এলাকায় মাচা করে থেকেছে মানুষজন। অনেকে নৌকার অভাবে কোথাও যেতে না পেরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের বাড়ির টিনের ওপরই অবস্থান করছে। ধুনটে নতুন করে ১৩ গ্রাম প্লাবিত : যুমনায় পানি বাড়তে থাকায় বাঁধের ভাঙা অংশের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গতকালও ধুনট উপজেলার ১৩টি গ্রাম ডুবে গেছে। গ্রামগুলো হলো বৈশাখী, বথুয়ারভিটা, রাধানগর, শহড়াবাড়ী, শিমুলবাড়ী, কৈয়াগাড়ী, বানিয়াজান, কচুগাড়ী, নিউ সারিয়াকান্দি, রঘুনাথপুর, ভূতবাড়ী, পুকুরিয়া ও আটাচর। সিরাজগঞ্জ : যমুনার পানি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গতকাল বিকেলে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে শুক্রবার কাজীপুর উপজেলার মেঘাই রিং বাঁধে আকস্মিকভাবে ধস নেমেছে। মুহূর্তের মধ্যে বাঁধভাঙা পানির জোয়ারে ডুবে গেছে কাজীপুর উপজেলার তিনটি গ্রাম। কুড়িগ্রাম : এ জেলায় নদ-নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদে ৯ সেন্টিমিটার পানি কমলেও এখনো বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে কুড়িগ্রাম জেলায় নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ৩৫টি গ্রাম। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর ও যাত্রাপুর-পাঁচগাছি পাকা সড়কের ওপর দিয়ে পানি ঢুকে সদর উপজেলার পাঁচগাছি ও যাত্রাপুর ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়। রৌমারী উপজেলার ইটালুকান্দা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রায় ২০ ফুট এবং ও কোমরডাঙ্গি রাস্তার প্রায় ১০ ফিট এলাকা ভেঙে গেছে। এতে বন্যার পানি ঢুকে নতুন করে প্রায় ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। রৌমারী (কুড়িগ্রাম) : রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলা বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার পানি কমলেও বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। রৌমারী-রাজীবপুরে সড়কে ফাটল দেখা দেওয়ায় এলাকায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সারিয়াকান্দির রৌহদহ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া এক শিক্ষার্থী বন্যার পানিতে ভিজে যাওয়া বই-খাতা শুকিয়ে নিচ্ছে। ছবি : কালের কণ্ঠ শেরপুর : শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের শেরপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়। এতে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের তিনটি ভাঙা অংশ দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করে চরাঞ্চলের পাঁচটি ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়। গাইবান্ধা : গতকাল তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি কিছুটা কমলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ৬২ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ফুলছড়ির ব্রহ্মপুত্র নদের ভাটি এলাকায় নতুন করে ১০টি গ্রাম এখন বন্যাকবলিত। মুন্সীগঞ্জ : জেলায় গতকাল বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ভাগ্যকুল পয়েন্টে পদ্মার পানি চার সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। ফলে গতকাল শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল ও বাঘরা, লৌহজংয়ের মেদিনীমণ্ডল, হলদিয়া, কনকসার, কুমারভোগ, কলমা, গাঁওদিয়া সিরাজদিখানের চিত্রকোট, টঙ্গিবাড়ী উপজেলার পাঁচগাঁও, হাসাইল-বানারী, সদর উপজেলার শিলই, বাংলাবাজারসহ অন্তত ১৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। শরীয়তপুর : জেলায় বন্যা পরিস্থিরি আরো অবনতি হয়েছে। পদ্মার পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে নড়িয়া উপজেলার প্রায় ১০টি পানের বরজ নষ্ট হয়ে গেছে। প্রবল স্রোতে পদ্মার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গতকাল সকালে শরীয়তপুরের সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রাজবাড়ী : পদ্মার রাজবাড়ী অংশে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। রাজবাড়ীর ভাগ্যকুল পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে এক সেন্টিমিটার। গতকাল দুপুর পর্যন্ত পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্তমানে জেলা সদরের মিজানপুর, বরাট ও দাদশী ইউনিয়নের এবং পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে থাকা নদীতীরবর্তী এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে। চাঁদপুর : দেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি চাঁদপুরের মেঘনা দিয়ে দক্ষিণের সাগরে তীব্র স্রোত নিয়ে নামছে। এ পরিস্থিতিতে গতকাল সকাল থেকে নদীতে জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে মেঘনা ও শাখা নদীগুলোতে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে বেশ কিছু চরের বাসিন্দার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক চড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, গতকাল দুপুরে মেঘনায় পানি বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে জোয়ারে তা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, এই মূহূর্তে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কোনো আশঙ্কা নেই। সামনে পানি প্রবাহের ওপর পরিস্থিতি নির্ভর করবে।
No comments:
Post a Comment