Wednesday, August 13, 2014

হলফনামায় মিথ্যাচার:যুগান্তর

নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় মিথ্যাচার করেছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী। তিনি ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। নবম সংসদ নির্বাচনের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়েছেন এমবিএ। আবার দশম সংসদ নির্বাচনের সময় নিজেকে এসএসসি পাস বলে দাবি করেন। তবে একবারও সনদপত্র জমা দেননি। এছাড়া নিয়ম লংঘন করে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর খেলাপি বিল পরিশোধ করেন। একইভাবে ঋণ পুনঃ
তফসিল করেন। কিন্তু পুনঃতফসিলের টাকা পরিশোধ করেননি বলে জানা গেছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোঃ জাবেদ আলী বলেন, নির্বাচিত কোনো ব্যক্তি নির্বাচনের আগে জমা দেয়া হলফনামায় তথ্য গোপন করে থাকলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। এর আগেও এ ধরনের তথ্য গোপনের দায়ে দু’জন সংসদ সদস্যপদ হারিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেয়া হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে ‘এমবিএ’ উল্লেখ করেন। কিন্তু এর সঙ্গে কোনো সনদপত্র দাখিল করেননি। আবার বিগত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে তার নির্বাচনী হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত ধারায় লেখেন- ‘আমার সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি এবং সার্টিফিকেটের কপি এতদসঙ্গে সংযুক্ত করিলাম।’ এ সময়ও তিনি কোন বোর্ডের অধীনে কোন স্কুল থেকে এসএসসি দিয়েছেন তা উল্লেখ করেননি। এখানে দুই নির্বাচনে দুই ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য দিয়ে হলফনামা জমা দিয়েছেন এই মন্ত্রী। এতে নির্বাচনী আইনের লংঘন হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে রফিকুল ইসলাম রসিক নামের এক ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনে লিখিত আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের দিনে আপত্তি আমলে নেয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের সাত দিন আগে প্রার্থীকে ঋণখেলাপিমুক্ত হতে হয়। সৈয়দ মহসিন আলীর ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। তিনি ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর মনোনয়ন দাখিলের পর ৫ ডিসেম্বর ঋণ পুনঃতফসিল করেন। পুনঃতফসিলের পরও তিনি যথাসময়ে টাকা পরিশোধ করেননি। এছাড়া বিলখেলাপির তালিকা থেকে নাম সরিয়ে নিয়েছেন মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড মৌলভীবাজার শাখা জরিফ টাওয়ার ১৯৯/২ এম সাইফুর রহমান রোড থানা ও জেলা মৌলভীবাজার থেকে এম আলী স’মিল অ্যান্ড লাভ লক ফার্নিচার পরিচালনার জন্য সৈয়দ মহসিন আলী ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। যথাসময়ে নিয়ম মেনে ঋণ পরিশোধ না করায় ঋণখেলাপি হন তিনি। ২০১২ সালের ১৯ জুন তারিখ পর্যন্ত এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৮২৮ টাকা ৬৩ পয়সা। এই টাকা আদায়ের জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩-এর ১২ ধারা মোতাবেক পত্রিকায় বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির দরপত্র বিজ্ঞপ্তি জারি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী খেলাপি ঋণ ২য় দফা পুনঃতফসিল করতে হলে ঋণের ২৫ শতাংশ জমা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকে তার জমা দেয়ার কথা ছিল ৩৫ লাখ টাকা। তখন তিনি নগদ জমা দেন ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাকি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধের জন্য সাত দিন সময় নিয়ে একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেন। পরে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিপরীতে একটি চেক দিলেও তা ক্যাশ হয়নি সময়ের মধ্যে। তখন দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তিনি ঋণের পুনঃতফসিল করেন। পরবর্তীতে এই চেকের টাকাও পরিশোধ না হওয়ায় ঋণটি খেলাপিতে পরিণত হয় যা বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনে বেআইনি। সাউথইস্ট ব্যাংক মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক সোয়েব আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি ছাড়া তিনি এ বিষয়ে কথা বলবেন না। তবে মন্ত্রীর ওই হিসাবটি আগের মতোই চলছে অর্থাৎ খেলাপি ঋণ এখনও পরিশোধ করা হয়নি বলে ইঙ্গিত করেন তিনি। মহসিন আলী বিদ্যুৎ বিল-খেলাপি ছিলেন যা নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী মনোনয়ন দাখিলের কমপক্ষে সাত দিন আগে পরিশোধ করার কথা। কিন্তু তিনি বিলখেলাপি থাকা অবস্থায় ২ ডিসেম্বর ২০১৩ মনোনয়নপত্র দাখিল করে ৩ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার সোনালী ব্যাংক প্রধান শাখায় ৫ লাখ ৫৯ হাজার ৯১১ টাকা খেলাপি বিল পরিশোধ করেন। যা জাতীয় সংসদের নির্দেশিকার পরিপন্থী। মৌলভীবাজার চেম্বারের সভাপতি কামাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করে এবং বিলখেলাপি থাকাবস্থায় সৈয়দ মহসিন আলী দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন। জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আসম ফিরোজ মনোনয়ন দাখিলের পাঁচ দিন আগে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার পরও তার সদস্যপদ কেন বাতিল করা হবে না মর্মে হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন। কিন্তু সৈয়দ মহসিন আলী মনোনয়ন দাখিলের পাঁচ দিন পর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে অর্ধেক টাকা পরিশোধ করেননি এবং খেলাপি বিল মনোনয়ন দাখিলের পরে পরিশোধ করেন। এত অনিয়ম করেও কিভাবে তার সংসদ সদস্যপদ বহাল থাকে এবং কেবিনেট মন্ত্রী হিসেবে টিকে থাকেন। তিনি কি আইন ও সব নিয়মের ঊর্ধ্বে- এ প্রশ্ন করেন চেম্বার সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কামাল হোসেন। তিনি আরও বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নাম জড়িয়ে নিজের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন মহসিন আলী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রীর এলাকার একাধিক প্রবীণ জানান, সৈয়দ মহসিন আলীর পিতা সৈয়দ আশরাফ আলী কলকাতা জাহাজ ঘাটের ঘাট সারেং ছিলেন। সৈয়দ মহসিন আলী ও তার ছোট ভাই সৈয়দ মোস্তাক আলী ছোটবেলায় সেখানে থাকতেন। তখন সৈয়দ মহসিন আলী ও তার ছোট ভাই সৈয়দ মোস্তাক আলী জাহাজ ঘাটের অদূরে একটি খ্রিস্টান মিশনারিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংলিশ মিডিয়ামে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তাদের বাবা মৌলভীবাজারে চলে আসেন। সঙ্গে আসেন দুই ভাইও। ১৯৬৭ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৬৮ সালে বার্ষিক পরীক্ষায় সৈয়দ মহসিন আলী অকৃতকার্য হন। আর স্কুলমুখী হননি। পরে ১৯৭২ সালে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে (প্রাইভেট) মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেও তিনি ফেল করেন বলে এলাকার প্রবীণরা জানান। এ প্রসঙ্গে সমাজকল্যাণমন্ত্রী মহসিন আলীর সঙ্গে কথা বলার জন্য সোমবার বিকাল থেকে কয়েক দফায় তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর রাত ৮টা ৫৮ মিনিটে তার ফোনের সংযোগ পাওয়া যায়। প্রথম দফায় কেউ ফোন ধরেনি। তবে দ্বিতীয় দফায় মন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্টাফ পারভেজ ফোন ধরে কথা বলেন। মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে পারভেজ বলেন, স্যার রেস্টে আছেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘ওই’ বিষয়ে কথা বলবেন না। ‘ওই’ বিষয়টি কী জানতে চাইলে পারভেজ কোনো উত্তর দিতে পারেননি। এ সময় তিনি বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে মন্ত্রী সাংবাদিকদের ডেকে কথা বলবেন। প্রতিবেদক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার গুরুত্ব তুলে ধরার পর পারভেজ জানান আধা ঘণ্টা পর তিনি নিজেই ফোন দিবেন। কিন্তু তিনি ফিরতি ফোন দেননি। ফোন বন্ধ থাকায় রাত সাড়ে ৯টার পর থেকে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি। মঙ্গলবার সচিবালয়ের দফতরে গিয়ে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। অফিস থেকে জানানো হয়েছে মন্ত্রী অফিসে আসেননি, এলাকায় চলে গেছেন। দফতর থেকে মন্ত্রীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু দিনভর ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।  

No comments:

Post a Comment