সরকার সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন ‘স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ’ বা স্বাচিপের মধ্যম সারির একজন প্রভাবশালী নেতা হঠাৎ করে পাল্টে ফেলেছেন আগের মোবাইল ফোন নম্বর। কারণ জানতে চাইলে বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘আর বলবেন না, কয়েক দিন ধরেই ফোনের জ্বালায় অতিষ্ঠ। ডাক্তাররা নিয়োগ পাওয়ার আগে থেকেই শুরু করেছে পছন্দমতো জায়গায় পোস্টিং বা আগাম বদলির তদবির। সকাল-বিকেল-রাত যখন তখন বিভিন্নজনের রেফারেন্স দিয়ে চেনা-অচেনা ফোন আসছে। কেউ
আবার সরাসরি দেখা করতে চাইছে।’ এই চিকিৎসক নেতা বলেন, ‘মাত্র আজই (গতকাল) নিয়োগ কার্যকর হওয়া ও যোগদান করা ডাক্তারদের আত্মীয়স্বজন এ রকম তদবির শুরু করেছে। অপারগতা প্রকাশ করেও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। তারা নাছোড়বান্দা। এমনকি আমি না পারলেও অন্য কাউকে সুপারিশ করে দিতে অনুরোধ জানায় একেকজন। এমন প্রবণতার নবীন ডাক্তাররা ভবিষ্যতে যে কী করবে তা ধারণা করাও কঠিন।’ কেবল চিকিৎসক নেতারাই নন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের পোস্টিং নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও তদবির তৎপরতা শুরু হয়েছে। এমন তৎপরতার মধ্য দিয়ে অসাধু পোস্টিং (পদায়ন) বাণিজ্যের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। কারণ অর্থ ব্যয় করে হলেও অনেকেই পছন্দের স্থানে পোস্টিং নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাঁদের কাছেও তদবির আসছে। কেউ ফোনে আবার কেউ চিরকুট পাঠিয়ে তদবির করছেন পছন্দের স্থানে তাঁদের প্রার্থীকে পোস্টিং দেওয়ার জন্য। গতকাল বৃহস্পতিবার একসঙ্গে ছয় হাজার ২২১ জন চিকিৎসকের নিয়োগ দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে এসব চিকিৎসকের দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালনের জন্য ওরিয়েন্টেশন দেওয়া হয়। এ জন্য রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানে ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ছয় হাজার ২২১ জন চিকিৎসকের সম্মিলন ঘটে। গতকাল নিয়োগ কার্যকর করা হলেও তাঁদের কর্মস্থল এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আগের মতোই গতকালও চিকিৎসকদের গ্রামে থাকার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দেন। গতকাল নিয়োগপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকে। ছোটকাল থেকেই বড় হয়েছি ঢাকায়। পড়াশোনাও ঢাকায়। কিন্তু আমার গ্রামের বাড়ি বরিশালের একটি উপজেলায়, যেখানে থাকার মতো ভালো কোনো পরিবেশ নেই। তাই চেষ্টা করছি ঢাকার আশপাশে কোথাও পোস্টিং পাওয়া যায় কি না।’ আরেক নারী চিকিৎসক কিছুটা ভয়ে ভয়েই বলেন, ‘শুনেছি, উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো একদম গ্রামপর্যায়ে। আমাকে যদি দুর্গম কোনো গ্রামে পোস্টিং দেওয়া হয় তবে হয়তো আমার চাকরিই করা হবে না। তাই বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা-তদবির করছি যাতে সুবিধাজনক একটি স্থানে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।’ বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডা. সারফুদ্দিন আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুরুতেই তদবির করে সুবিধা আদায়ের মানসিকতা তৈরি হলে তাদের ভবিষ্যৎ কোনোভাবেই ভালো হতে পারে না। এরা সারা জীবনই তদবিরের ওপর চলতে চাইবে। এ ধরনের তদবিরকে কারোরই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না।’ ওই চিকিসক নেতা বলেন, সরকার গ্রামের মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্যই নতুন চিকিৎসকদের গ্রামে পোস্টিং দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাঠপর্যায়ে বেশির ভাগ হাসপাতালেই চিকিৎসক সংকট প্রকট। এই সংকট দূর করতে এবং কাজের দক্ষতা বাড়াতেই নতুন চিকিৎসকদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গ্রামে থাকা অপরিহার্য। কিন্তু নিয়োগ হতে না হতেই এমন তদবির প্রবণতা মেনে নেওয়া যায় না। গতকালের যোগদান অনুষ্ঠানে নতুন ডাক্তারদের উদ্দেশে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, যাঁদের যে স্থানে পদায়ন করা হবে, আগামী দুই বছর বাধ্যতামূলক তাঁদের সেই স্থানে থেকেই জনগণকে চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। দুই বছরের আগে নতুন নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকরা নিজ কর্মস্থল থেকে বদলি হতে পারবেন না। যাঁরা এর ব্যত্যয় ঘটাবেন তাঁদের কোনো রকম ছাড় দেওয়া হবে না। দুই বছর পরে তাঁদের সুবিধাজনক পদায়ন এবং প্রয়োজনে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। মন্ত্রী বলেন, এখন গ্রামেও শহরের মতো পাকা রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, উন্নত মার্কেট, মানসম্মত স্কুল-কলেজ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই এখন চিকিৎসকদের বসবাসের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। তাই গ্রামে থাকতে অনীহার কোনো কারণ নেই। তিনি শহরের খাদ্যে বিষের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘গ্রামের মানুষ বিষমুক্ত খাবার খেতে পারে। গ্রামে ফরমালিন নেই, আপনারা ফরমালিনমুক্ত খাবার খাবেন।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘শহরের চেয়ে গ্রামে দরিদ্র মানুষ বেশি। ধনীদের জন্য শহরে দামি দামি বড় বড় হাসপাতাল আছে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ভরসা আপনাদের ওপর।’ কথায় কথায় ধর্মঘট না ডাকতে হুঁশিয়ার করে দিয়ে ডাক্তারদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, রোগীকে টেবিলে ফেলে রেখে ধর্মঘট করা যাবে না। কোনোভাবেই ধর্মঘট করার চিন্তা করবেন না। ছোটখাটো সমস্যা হতে পারে, তবে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, চিকিৎসকরা কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে যেন নির্বিঘ্নে সেবা দিতে পারেন সে জন্য শিগগিরই আইন প্রণয়ন করা হবে। রোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ভুল হতে পারে, কিন্তু সে জন্য তাঁদের লাঞ্ছিত করা হবে এবং হাসপাতাল ভাঙচুর হবে, তা আদৌ কাম্য নয়। একই সুরে কথা বলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাচিপের সভাপতি অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক। তিনি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেন, ‘গ্রাম এখন আর আগের মতো অনুন্নত নেই। গ্রামের মানুষ আপনাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।’ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকও গ্রামের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানান। এদিকে চিকিৎসকদের গ্রামে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে বেশি কঠোর অবস্থান সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের দিক থেকে আরো কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যেমন জরুরি, তেমনি একই সঙ্গে ডাক্তারদের গ্রামে থাকার জন্য, চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত উপযুক্ত পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা ও প্রযুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের উৎসাহ দিতে হবে, নিরাপত্তা দিতে হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে- চিকিৎসা পেশা কেবল চাকরি নয়, এটি মানুষের সর্বোত্তম সেবামূলক একটি কাজ। কিন্তু আমরা গ্রামপর্যায়ে চিকিৎসকদের জন্য এমন ব্যবস্থাপনা দেখছি না।’ তবে পদায়ন সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন চিকিৎসকরা আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে চাকরিতে যোগদান করেছেন। এখন আমরা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে পোস্টিংয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এ কাজে হয়তো সপ্তাহখানেক সময় লাগতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা আগেই প্রত্যেকের স্থানীয় ঠিকানাকে বিবেচনায় নিয়েছি। পাশাপাশি বিবাহিতদের ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীর বসবাসের স্থানকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে তাঁদের অভিভাকদের অবস্থানের স্থানকেও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।’ এদিকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের পোস্টিং নিয়ে কোনো রকমের তদবির বাণিজ্যের আশঙ্কা নেই এবং তা করতে দেওয়া হবে না দাবি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যপাক ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনার প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ সব দিক বিবেচনায় নিয়েই গ্রামে পোস্টিং দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তদবিরকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
No comments:
Post a Comment