Saturday, August 9, 2014

মিলছে না পিনাকের সন্ধান : বাড়ছে ক্ষোভ:নয়াদিগন্ত

স্বজনের দেখা না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হলো ১২টি লাশ। অন্য দিকে প্রিয়জনের লাশের সন্ধানে ছুটছেন স্বজনেরা। এক দিকে লাশ না পেয়ে কান্নায় ভারী করছেন আকাশ-বাতাশ, অন্য দিকে প্রিয়জন না আসায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হতে হলো হতভাগ্য এই ১২ জনকে। গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা পাচ্চর হাইস্কুল মাঠে জানাজা নামাজ শেষে শিবচর পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয় তাদের। তবে দাফনের আগে লাশের শরীর থেকে ডিএনএ টেস্টের জন্য প্রয়োজনীয়
আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন। এ দিকে পাচ্চর স্কুলের চার পাশে ভিড় জমাচ্ছেন স্বজনেরা। তাদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে এলাকার বাতাস। ওই এলাকায় লাশের গন্ধের সাথে স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস একাকার হয়ে যাচ্ছে।  গতকাল শুক্রবার সকালে শিবচরের পাচ্চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় নিখোঁজদের স্বজনদের ভিড়। স্কুলমাঠে যে ক’টি লাশ সারিবদ্ধ রাখা ছিল তার প্রতিটির মাঝে নিজের স্বজনদের খুঁজছিলেন প্রিয়জনেরা। হাইস্কুল মাঠের নির্মিত ক্যাম্প থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল হোসাইন জানান, পাঁচ দিনের লাশ। প্রতিটি লাশে পচন ধরেছে। তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। যার কারণে লাশগুলো দাফন না করে উপায় ছিল না। তিনি বলেন, স্বজনেরা কেউ না আসায় এবং এদের পরিচয় উদ্ধার করতে না পারায় গতকাল পর্যন্ত ১২টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। দাফনের আগে প্রতিটি লাশের শরীর থেকে ডিএনএ টেস্টের জন্য আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এই লাশগুলোর সব ডকুমেন্ট শিবচর উপজেলা পরিষদ অথবা এসপির কার্যালয়ে রাখা হবে। কোনো স্বজন লাশের সন্ধানে এলে তারও ডিএনএ টেস্ট করা হবে। এরপর দু’টি টেস্টের রিপোর্ট মিলে গেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে ওই লাশটি তার স্বজনের কিনা। ডিএনএ টেস্টের জন্য জেলা সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। ওই টিমের সদস্যরা সব আলামত সংগ্রহ করছেন। ইকবাল হোসাইন আরো বলেন, ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রতিটি লাশ দাফন করা হবে।  সন্ধান পাওয়া যায়নি লঞ্চটির দুর্ঘটনার পর পাঁচ দিন অতিবাহিত হলেও খুঁজে পাওয়া যায়নি পিনাক-৬। উদ্ধারে সব ধরনের চেষ্টা করা হলেও লঞ্চের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি চট্টগ্রাম থেকে আসা উদ্ধারকারী জাহাজ কাণ্ডারী ২-এর সাথে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংবলিত জরিপ-১০ অনুসন্ধান চালালেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বশেষ বিকেল ৫টার দিকে দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া সোলায়মানকে (২৫) সাথে নিয়ে দুর্ঘটনাস্থল খুঁজতে যায় নৌবাহিনীর এলসিটি বোট। উদ্ধারকারী কাজের কো-অর্ডিনেটর নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম বিকেলে জানান, হাইটেক ও ম্যানুয়েল সিস্টেমের ইকুইপমেন্ট দিয়ে ভাটিতে ৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। কিন্তু সিগনিফিকেন্ট পয়েন্টে কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে এসব এলাকায় কিছু সিলেকটিভ পয়েন্ট আমরা পেয়েছি। তা শুক্রবার থেকে ডিটেইল সার্চ করা হবে বলে তিনি জানান। তিনি আরো জানান, বিগত সময়গুলোতে আমরা সাধারণত শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ ইকুইপমেন্টের কাজ করেই ডুবে যাওয়া লঞ্চ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। এ ক্ষেত্রে আরো সময় লাগবে বলে তিনি মনে করেন। তবে কত সময় লাগবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা।  এ দিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছেড়ে আসা মাল্টিবিম ইকোসাউন্ডার বহনকারী অনুসন্ধানকারী জাহাজ জরিপ-১০ রাত ৩টার দিকে মাওয়া ঘাটে পৌঁছায়। গতকাল সকাল থেকে জাহাজটি অনুসন্ধান শুরু করে। জাহাজটি তিন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র (সাইড স্ক্যান সোনার, সাব বটম প্রোপাইলার ও জিপিএস) নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে। ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ শনাক্তকরণে সাইড স্ক্যান সোনার, সাব বটম প্রোপাইলার ও গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস)Ñ এই তিন যন্ত্র নিয়ে কাজ শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে জরিপ-১০ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাওয়ায় আসার পথে প্রতিকূল আবহাওয়ার কবলে পড়ে। সেখানে আড়াই ঘণ্টা পর কাণ্ডারী-১ তাকে সমুদ্র এলাকা পাড় করে দেয়। এ দিকে শুক্রবার জরিপ-১০, কাণ্ডারী-২ ছাড়াও নৌবাহিনীসহ বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএ ও ফায়ার সার্ভিসসহ পাঁচটি সংস্থার জাহাজ লঞ্চটি উদ্ধারে তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে কোনো অগ্রগতি নেই। থামছে না স্বজনের আহাজারি মাওয়া ঘাটে থাকা সেই কিশোর আকরামকে পাওয়া গেলো শিবচরের পাচ্চর হাইস্কুল মাঠে। মা-বাবাকে খুঁজে পায়নি সে। তবে ছোট বোন আইরিনের লাশ পেয়েছে পাচ্চরের মাঠে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার মাওয়া ঘাটে কথা হয়েছিল আকরামের সাথে। তার বাবা দুলাল (৪০), মা তাসলিমা (৩২) ও একমাত্র ছোট বোনকে নিয়ে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসছিল। কাওরাকান্দি এসে পিনাক ৬-এ ওঠার পর দুর্ঘটনায় পড়ে তারা। এর পর থেকেই নিখোঁজ বাবা, মা ও বোনের সন্ধানে গত চার দিন মাওয়া ঘাটে অপেক্ষা করার পর জানতে পারে শিবচরের পাচ্চর হাইস্কুল মাঠে উদ্ধারকৃত লাশ রাখা হচ্ছে। খবর পেয়ে ছুটে যায় সেখানে। অবশেষে পাঁচ দিনের মাথায় বোনের লাশটি পেলেও খুঁজে পাচ্ছে না বাবা-মায়ের লাশ। কিশোর আকরাম জানায়, আমি বাবা-মায়ের লাশ খুঁজে পাচ্ছি না। অন্য দিকে বেওয়ারিশ লাশগুলো দাফন হয়ে গেলো। জানি না আমার বাবা-মায়ের ভাগ্যে কী আছে। পাঁচ দিন পর মিজানুরের লাশ পাওয়া গেলো পাচ্চর স্কুল মাঠে। তবে এখনো পাওয়া যায়নি মিজানুরের স্ত্রী রোকসানা (২৭), দুই সন্তানÑ মিলি আক্তার (৯) ও মাহিনের (২) লাশ। তাদের লাশ খুঁজছেন স্বজনেরা। ৪০ লাশ উদ্ধার : গত পাঁচ দিনে মোট ৪০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার মাওয়ার ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন নদনদী থেকে আরো সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে। ৪০টি লাশের মধ্যে ২১টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ১২টি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। বাকিগুলোর পরিচয় পাওয়া যায়নি।  এ দিকে লঞ্চের অনুসন্ধান বা নিখোঁজ যাত্রীদের লাশ না পেয়ে পদ্মাপাড়ে স্বজনদের ক্ষোভ আরো বেড়েই চলেছে। সরকারি উদ্ধার কাজে কোনো অগ্রগতি না পেয়ে নিখোঁজদের স্বজনেরা ব্যক্তিগতভাবে ট্রলার নিয়ে খুঁজছেন পদ্মার ভাটি এলাকায়। ট্রলারে ১০-১২ জন স্বজনকে পদ্মার দিকে ছুটতে দেখা গেছে। এ দিকে সন্ধ্যা ৭টায় মাওয়ায় পদ্মা রেস্ট হাউজে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের সাথে বলেছেন, লঞ্চডুবির ঘটনায় আমার পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না। লঞ্চ উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে। উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত অভিযান বন্ধ হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি জোট সরকারের আমলে অনেক নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে। এখন অনেক কম। ’৯২ সালের পর থেকে মাওয়ায় এই প্রথম দুর্ঘটনা বলে দাবি করেন তিনি।

No comments:

Post a Comment