Monday, August 18, 2014

ভাঙন আতঙ্কে বানভাসিরা:কালের কন্ঠ

উত্তর ও উত্তর-পূর্ব জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এর মধ্যে আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং বাঁধগুলো সংলগ্ন এলাকায় নদীভাঙন। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তার প্রান্তিক বাঁধ ও বিজয় বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। নীলফামারীর জলঢাকায় তিস্তা নদীর আরেক বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধও মারাত্মক হুমকির মুখে। ইতিমধ্যে বাঁধ রক্ষার এক হাজার ৭০০ স্পারের অর্ধেক নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এ বাঁ
ধে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোর আবারও গৃহহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা  দেখা দিয়েছে। রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলায় ভাঙতে ভাঙতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ থেকে পদ্মার দূরত্ব এখন মাত্র ১৫-২০ মিটার। কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার গাছবাড়ি বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। প্রতিটি বাঁধ ভাঙনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিম্নমানের কাজকে দায়ী করছে স্থানীয় মানুষ। এদিকে, বন্যাকবলিত জেলাগুলোর মধ্যে তিস্তাসহ কয়েকটি নদ-নদীতে পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। এর মধ্যে নতুন করে পানি বৃদ্ধি না হলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতির খবরও পাওয়া গেছে। কুড়িগ্রাম ও চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কুড়িগ্রামে একটি সেতুর সংযোগ সড়ক ভেঙে যাওয়ায় সোনাহাট স্থলবন্দরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ এবং সুনামগঞ্জ সদরের সঙ্গে তাহিরপুর উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। রংপুরে বন্যায় পানিবন্দি চার সহস্রাধিক পরিবারের দুর্ভোগ কমেনি। তিন দিন ধরে চরাঞ্চলের এসব পরিবারে কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। তবে তিস্তার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। গত কয়েক দিনে উপজেলার পাইকান হাজীপাড়া এলাকার একটি প্রান্তিক বাঁধ ও মহীপুর এলাকার বিজয় বাঁধে ব্যাপকহারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। আতঙ্কে আছে ওই এলাকার পরিবারগুলো। গতকাল রবিবার সরেজমিন দেখা গেছে, পাইকান ব্যাঙপাড়া এলাকায় প্রান্তিক বাঁধের ৫০০ ফুট এবং মহীপুর এলাকায় বিজয় বাঁধের প্রায় ২০০ ফুট এলাকা ধসে গেছে। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রক্ষায় নির্মিত সলিড স্পার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, জরুরি ভিত্তিতে দায়সারা গোছের কাজ করিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গতকাল বিকেলে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া পদ্মার তীব্র ভাঙনে হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের দেড় কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এর মধ্যে ৩৫০ মিটার এলাকা ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার উপক্রম। গতকাল দুপুর পর্যন্ত নদী ও বাঁধের দূরত্ব ছিল মাত্র ১৫-২০ ফুট। এ বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জেলার পাংশা ও কালুখালী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার আবাদি জমি, ঘরবাড়ি ও সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে এই আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিতে পারে বল জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। তবে রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী লুৎফুর রহমান জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। প্রবল বর্ষণ ও ব্রহ্মপুত্রে পানি বৃদ্ধির ফলে নদের তীরবর্তী ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দুই উপজেলার পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর ডুবে গেছে। বন্যার পানির চাপে রৌমারী উপজেলার গাছবাড়ি বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। কুড়িগ্রাম সদরে গতকাল ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে জেলার দুধকুমার নদের তীব্র স্রোতে সোনাহাট স্থলবন্দরের সংযোগ স্থাপনকারী সোনাহাট ব্রিজের সংযোগ সড়ক ভেঙে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সোনাহাট স্থলবন্দরের যোগাযোগব্যবস্থা। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। গতকাল সকালে গোলজার ও অপিয়াল নামের দুই ব্যক্তির বাড়ি ভাঙনের পর তারা এলাকা ত্যাগ করেছেন। জেলা পরিষদ ভূরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরী উপজেলায় ত্রাণ হিসেবে ১০ টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে। বন্যায় রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জের সঙ্গে তাহিরপুর উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সড়কটির বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলা থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। এ ছাড়া পানির চাপে তাহিরপুর-বাদাঘাট সড়কের একাধিক স্থান ভেঙে গেছে। উপজেলার ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। রংপুরে তিস্তার পানি কিছুটা কমে এলেও বগুড়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের মূল শাখা যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি গতকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও গতকাল দুপুর পর্যন্ত বগুড়ায় যমুনার পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে চরাঞ্চলের কিছু এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। তবে বগুড়ার শেরপুরে প্লাবিত এলাকায় আউশ মৌসুমে কৃষকদের জনপ্রিয় ‘আপৎকালীন ধান’ চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আউশ মৌসুমের জিরাশাইল ও পারিজাত দুটি ধানের অধিক ফলন বর্ষা শেষে অভাব দূরীকরণে কাজ দেয় বলে স্থানীয় কৃষকরা এদের আপৎকালীন ধান বলে থাকেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার বরেন্দ্রখ্যাত পাঁচটি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় লাগানো জিরাশাইল ও পারিজাত জাতের ধান পানিতে ভাসছে। কৃষকের চোখের সামনেই তা পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার ১০ গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে ওইসব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া নালিতাবাড়ী পৌরসভার একাংশসহ এই উপজেলার চারটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমির ধান। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে ফটিকছড়ির ভূজপুরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। উপজেলার অসংখ্য আঞ্চলিক সড়ক ভেঙে অথবা কার্পেটিং উঠে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। নানুপুর ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ আবদুল মান্নান বলেন, ‘নানুপুর-মাইজভাণ্ডার সড়কের পাশে নয়াবাড়িতে আমার বাড়ি। বন্যায় আমার ঘরের পাশের রাস্তা ভেঙে বিনাজুড়ি খালের সঙ্গে মিশে গেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেখেও গেলেন। এখনো তেমন কোনো সাহায্য পাইনি।’ কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন শাহপরীর দ্বীপের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধটি গতকাল হেলিকপ্টারে চড়ে পরিদর্শন করেছেন পানি সম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। মন্ত্রীর আগমনের খবরে আগে থেকেই শত শত জনতা বেড়িবাঁধে ভিড় জমায়। ২০১২ সালে জোয়ারে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধটি ভেঙে যাওয়ার পর পানি সম্পদমন্ত্রীর এই পরিদর্শন এলাকাবাসীর মনে নতুন আশা জাগিয়েছে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রংপুর, জলঢাকা (নীলফামারী), রাজবাড়ী, কুড়িগ্রাম, রৌমারী (কুড়িগ্রাম), বগুড়া, শেরপুর, তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ), টেকনাফ (কক্সবাজার) ও ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম)-এর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।

No comments:

Post a Comment