Wednesday, April 22, 2015

রহস্যময় এক নারীকে খুঁজছে গোয়েন্দারা:যুগান্তর

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলা নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার তদন্তে বেশকিছু নতুন ক্লু পাওয়া গেছে। এসব ক্লু সত্য হলে মামলা ইউটার্ন নিতে পারে। নতুন ক্লু হিসেবে উঠে এসেছে রহস্যময় এক নারীর নাম। যিনি ঘটনার দিন ত্বকীর সঙ্গে শীতলক্ষ্যার পাড়ে দীর্ঘ সময় ধরে গল্প করেছিলেন। এছাড়া এ বিষয়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরও সন্ধান পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ সাক্ষী
র বক্তব্যে মামলার নতুন রহস্য বেরিয়ে আসবে। তবে এতদিন পর মামলার তদন্তে এসব বিষয় সামনে আনাকে উদ্দেশ্যমূলক বলে অভিহিত করেছেন ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বি। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, একটি প্রভাবশালী পরিবারকে বাঁচাতে মামলার তদন্তে নতুন নাটক সাজানো হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ তিন ক্লু : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লু উদঘাটিত হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এসব ক্লু এতদিন সামনে আনা হয়নি। মামলা তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত ওসমান পরিবারের ছেলে আজমেরী ওসমানের অফিসে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর আজমেরী ওসমানের অফিস থেকে রক্তমাখা প্যান্টও উদ্ধার করা হয়। কিন্তু পুলিশের তৈরি করা সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাশ উদ্ধারের সময়ই ত্বকীর পরনে জিন্স প্যান্ট ও শাট ছিল। এ কারণেই এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে- তাহলে উদ্ধারকৃত প্যান্টটি কার ছিল? দ্বিতীয় ক্লু হচ্ছে, লাশের পায়ে থাকা স্যান্ডেল। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতারকৃত আসামিরা জবানবন্দি দেয়, ত্বকীকে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু লাশ উদ্ধারের সময় বস্তাটি পাওয়া যায়নি। আবার ত্বকীর স্যান্ডেল জোড়া তার দু’পায়ে পরানো অবস্থায় ছিল। এখন প্রশ্ন হল, নির্যাতনের পর লাশ বস্তায় ভরে পানিতে ডুবিয়ে দেয়ার পরও ত্বকীর পায়ে স্যান্ডেল থাকা সম্ভব কিনা। এ বিষয়টি এখন তদন্ত কর্তৃপক্ষকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। তৃতীয় ক্লু হচ্ছে, গ্রেফতারকৃত দুই আসামির দু’রকম জবানবন্দি। গত বছর ২৯ জুলাই ইউসুফ হোসেন লিটন নামের এক যুবক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ত্বকীকে সালেহ রহমান সীমান্তর বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এ মামলার সন্দেহভাজন আরেক আসামি সুলতান শওকত ভ্রমর তার জবানবন্দিতে বলেন, ত্বকীকে আজমেরী ওসমানের অফিসেই হত্যা করা হয়েছে। জবানবন্দিতে তিনি হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনাও দেন। অবশ্য আদালতে এ জবানবন্দি দেয়ার আগে ভ্রমর ৩ মাস ১৪ দিন নিখোঁজ ছিলেন। পরে র‌্যাব তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে। দুই আসামি হত্যাকাণ্ডের দু’রকম স্থান চিহ্নিত করে জবানবন্দি দেয়ায় ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়। পরে ভ্রমর তার জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করলে বিষয়টি আরও জট পাকিয়ে সন্দেহের দিকে ধাবিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষীর সন্ধান : তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, মামলার তদন্ত নতুন মোড় নিতে পারে এমন দু’জন সাক্ষীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এই দুই সাক্ষীর মধ্যে একজন চাঁদপুরের হাশেম হাওলাদারের ছেলে আলামিন হোসেন। আলামিনের বক্তব্য সংবলিত দুটি ভিডিও রেকর্ড তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তরও করা হয়েছে। যুগান্তরের কাছে আসা ওই ভিডিও চিত্রে আলামিন বলেন, তিনি এবং তার পূর্ব পরিচিত আলমগীর দু’জনেই নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে ওয়েটারের চাকরি করতেন। প্রতিদিন ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাদের ছুটি থাকত। ছুটি থাকায় প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা দু’জনে বিকালে ঘুরতে বের হতেন। ত্বকী নিখোঁজ হওয়ার দিনও তারা শহরের ৫নং ঘাট এলাকায় ঘুরতে বের হন। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ৫নং ঘাট এলাকায় বসে মোবাইল ফোনে গান শুনছিলেন এবং আড্ডা দিচ্ছিলেন। একটু পরেই সেখানে ত্বকী ও একটা মেয়ে এসে বসেন। কিছুক্ষণ পর ত্বকী ও তার সঙ্গী মেয়েটির মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু হয়। এ অবস্থা দেখে তারা মোবাইলে গান শোনা বন্ধ করে দেন। খুব কাছে বসে থাকায় তারা শুনতে পান, ত্বকী মেয়েটিকে বলছে ‘যত টাকা লাগে আমি দিমু ঢাকায় কলেজে ভর্তি হ’। এতে ত্বকীর সঙ্গে থাকা মেয়েটি উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে আগে ট্যাকা দে। পরে ভর্তি হমু। ত্বকী বলে, তোর জিদ খুব খারাপ। জিদ উঠলে তুই মানুষও মেরে ফেলিস। এরপর দু’জনেই কিছুক্ষণ নীরব থাকে। কিছুক্ষণ পর ত্বকী সেখান থেকে উঠে চলে যায়। এরপর সেখানে আরেকটা ছেলে আসে। ছেলেটি এসে মেয়েটির কাছে ত্বকীর অবস্থান জানতে চায়। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ পর ত্বকী সেখানে আসলে মেয়েটি ত্বকীর সঙ্গে নতুন আসা ছেলেটিকে বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরিচয়ের পর ছেলেটি কিছুটা দূরে গিয়ে বসে থাকে। এরপর ত্বকী ও তার সঙ্গী মেয়েটির মধ্যে আরও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হতে থাকে। একপর্যায়ে সেটা ঝগড়ায় রূপ নেয়। এর মধ্যে সন্ধ্যা নেমে আসে। চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ভিডিও রেকর্ডে দেখা যায়, ‘আলামিন বলছেন, আমি ত্বকীকে চিনতাম না। একটা ছেলে, একটা মেয়ের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে এটা দেখে আমরা সেদিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে ছিলাম এবং তাদের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করি। সন্ধ্যার পর আমরা সেখান থেকে উঠে চলে যাই। পরদিন তার সহকর্মী ও বন্ধু আলমগীর প্রথম তাকে ফোন করে বলে, ‘আলামিন ঘটনা তো একটা ঘটছে। আমরা যে ছেলেটাকে ওইদিন নদীর পাড়ে একটা মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেছিলাম তার নাম ত্বকী। সে খুন হইছে। নদী থেকে তার লাশ পাওয়া গেছে। পরদিন দেখি যে মেয়েটির সঙ্গে ত্বকীর ঝগড়া হয়েছিল সেই মেয়েটি ত্বকীর ছবি লাগানো ব্যানার নিয়ে মিছিল করছে। এ ঘটনার বিষয়ে আমরা প্রথমে আমাদের মাসুদ স্যারের সঙ্গে (ক্লাবের একজন কর্মকর্তা) আলোচনা করি। তিনি আমাদের প্রথমে কালীর বাজার র‌্যাব অফিসে এবং পরে র‌্যাবের আদমজী ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তকারী এএসপি রবিউল, অপর একজন পুরুষ ও একজন মহিলা অফিসার আমাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং নানা ধরনের প্রশ্ন করেন। পরে তারা আমাদের ভয় দেখিয়ে বলেন, ঘুষ খাইয়া গল্প সাজাইতে আসছিস। এখান থেকে আর বের হতে পারবি না। হাজতে ঢুকিয়ে দিব।’ জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সাক্ষী এতদিন প্রাণভয়ে পালিয়ে ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব-১১ শীর্ষ তিন কর্মকর্তা গ্রেফতার হওয়ার পর তারা আবারও নারায়ণগঞ্জে ফিরে এসেছেন। রহস্যময় নারীর খোঁজ : এই দুই সাক্ষীর দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী ওই নারীর খোঁজ চলছে। সূত্র জানিয়েছে, ওই নারী বাম রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তিনি ধুমপানসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত। তার জীবনযাপনও বিশৃংখল। একটি সূত্র দাবি করেছে, ইতিমধ্যে আইনশৃংখলা বাহিনী তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। তবে এ তথ্যের সত্যতার বিষয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যা বললেন রফিউর রাব্বি : তদন্তের নতুন মোড় নেয়া ও নতুন এসব তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বি যুগান্তরকে বলেন, মামলাটি ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য নতুন নাটক সাজানো হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার সন্তান তো জীবিত নেই। তাকে তো খুন করা হয়েছে। এর চেয়ে বড় সত্য তো আর কিছু নেই। দীর্ঘ দুই বছরেও খুনিরা গ্রেফতার হল না। এখন নতুন নাটক সাজিয়ে খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে। মামলার তদন্তে নতুন অগ্রগতি সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। শুধু বলব, ঘটনাটির সঠিক এবং বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত হোক। প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক। এতে যদি আমার পরিবারের কারও ফাঁসি হয়ে যায়, হোক। আমি নির্দিধায় শাস্তি মেনে নেব।’ প্রসঙ্গত, মেধাবী ছাত্র তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নিখোঁজ হন। ত্বকীর এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গোটা দেশ ফুঁসে ওঠে। ঘটনার পর এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের হাত আছে বলে অভিযোগ ওঠে। মামলাটির তদন্ত করছে র‌্যাব। র‌্যাব সূত্র জানিয়েছে, তাদের তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে।  

No comments:

Post a Comment