Sunday, August 31, 2014

গণমাধ্যমকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতেই সম্প্রচার নীতিমালা:নয়াদিগন্ত

সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনায় দেশের গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট শীর্ষ ব্যক্তি ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের জন্যই জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা করা হয়েছে। এই নীতিমালা গণমাধ্যমকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার জন্য। এই নীতিমালার পদে পদে যা রয়েছে তা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার প্রয়াস। এই নীতিমালা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।  রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল শনিবার বিকেলে ‘গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক
আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন পরিষদের সভাপতি সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। সূচনা বক্তব্য দেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম।  আলোচনায় অংশ নেন শিাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম রহমান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল ওনার্সের সাধারণ সম্পাদক শাইখ সিরাজ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ, মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাম্পাদক পরিষদের সদস্য রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, জাতীয় প্রেস কাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, মাছরাঙ্গা টিভির সিইও ফাহিম মোনায়েম, ৭১ টিভির সিইও মোজাম্মেল বাবু, এটিএন বাংলার বার্তা প্রধান জ ই মামুন, এটিএন নিউজের বার্তা প্রধান মুন্নী সাহা প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবির, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, বিএফইউজের মহাসচিব এম এ আজিজ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল হাই শিকদার, সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত।  সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা বিপদের মধ্যে আছি। একের পর এক বিপদ আসছে। সম্প্রচার নীতিমালাও বিপদ হয়ে আসছে, আপদও হতে পারে। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ এসেছে তাদের মধ্যে ঐক্য না থাকার কারণে। পাকিস্তান আমলেও আক্রমণ হয়েছে কিন্তু তখন তারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। তিনি বলেন, বর্তমানে জরুরি অবস্থা নেই, সামরিক শাসন নেই তারপরও এতগুলো নিষেধ করার ধারা। রবীন্দ্রনাথ এটাকেই ১২০ বছর আগে বলেছিলেন ‘কণ্ঠরোধ’। আজ সেই কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হচ্ছে। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। গণমাধ্যম এমনিতেই ভীষণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। মালিকদের, বিজ্ঞাপনদাতাদের নিয়ন্ত্রণ। তার মধ্যে আবার নতুন নিয়ন্ত্রণ। তিনি বলেন, মিডিয়া হচ্ছে শেষ ভরসার জায়গা। মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করলে শেষ ভরসার জায়গা কণ্ঠরোধ হয়ে যাবে।  মাহফুজ আনাম বলেন, এই নীতিমালা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের বিকাশের পরিপন্থী। বিভিন্ন দিক থেকে দেশের যে অর্জন তাতে গণমাধ্যম বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। এখন গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে দেশের অর্জনকে প্রতিহত করা। সম্প্রচার নীতিমালার অধিকাংশ বিষয়ই স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিপন্থী। বিদ্যমান আইন ও নীতিমালায় গণমাধ্যম যদি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে নতুন নীতিমালার প্রয়োজন কেন? তা-ও এমন নীতিমালা, যা অগ্রগতির প্রতিবন্ধক বলে ধারণা। তিনি বলেন, নীতিমালার তৃতীয় থেকে পঞ্চম অধ্যায়ে ৭০টি অনুচ্ছেদ আছে যাতে কোনো রকমের উৎসাহব্যঞ্জক কিছু নেই,্ আছে শুধু পারবে না, পারবে না। বলা হয়েছে, দেশবিরোধী বক্তব্য দেয়া যাবে না। কোনটা দেশবিরোধী সেটা নির্ণয় করবে কে? তিনি বলেন, দেশের স্বার্থবিরোধী কোনটি হচ্ছে বলুন। হলেও আমরা সংশোধন করছি, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তারপর প্রেস কাউন্সিল আছে। নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক আইন আছে। অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ল কেন? তিনি ৫.১.৪ ধারার উল্লেখ করে বলেন, কেউ বলতে পারবে না গণমাধ্যমের কাজের জন্য কোনো দিন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘিœত হয়েছে। কেন বেসামরিক ও সরকারি তথ্য প্রকাশ করা যাবে না? এটা গণমাধ্যমকে আবদ্ধ করার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। ৫.১.৫ ধারার উল্লেখ করে তিনি বলেন, বলা হয়েছে পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা, ম্যাজিস্ট্রেটের পেশাগত ভাবমর্যাদা ুণœ হয় এমন কিছু লিখতে পারবে না। এই আইন থাকলে তো দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা নিয়ে লেখা যেত না। কারণ তার সাথে এনএসআই, ডিজিএফআই জড়িত বলে প্রমাণ হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়েও লিখতে পারতাম না। প্রতিবেশী দেশের ভাবমর্যাদা ুণœ হয় এমন বিষয় প্রকাশ করা যাবে না। এই নীতি হলে তিস্তা নিয়ে আমরা যদি লিখি তাহলে ভারতের ভাবমর্যাদা ুণœ করার প্রয়াস বলা হতে পারে। মোটকথা যে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, পড়ে দেখেন পদে পদে গণমাধ্যমকে বেঁধে রাখার প্রয়াস, যা একেবারেই নিন্দনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য।  তিনি বলেন, এই নীতিমালার আলোকে গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতিমালা করার কথা বলা হয়েছে। তাহলে আর সম্পাদক থাকার দরকার কী? এটা সম্পাদকদের একেবারে নিরস্ত্র করার উদ্যোগ। এই নীতি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এই নীতিমালায় যা নেই তার ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে মর্মে বলা হয়েছে। সরকার এভাবে নীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে অগ্রগতিতে গণমাধ্যমের কি সামান্যতম অবদানও নেই? উন্নয়নের আমরা কি অংশীদার নই? বাংলাদেশের সামনে যে সম্ভাবনা, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করলে সেই সম্ভাবনাকেই মূলত রোধ করবে। এটা আত্মঘাতী হবে। ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম বলেন, এই নীতিমালা করতে অংশীজনদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। এই নীতিমালাটি এত দ্রুত প্রকাশ করা হয়েছে যে কাজটি দেখে মনে হয় যারা এটা করতে উৎসাহিত করেছেন তারা সরকারকে বিব্রত ও ক্ষতি করার জন্য করেছেন। যারা এটা করিয়েছেন তারা সরকারের বন্ধু কি না প্রশ্ন জাগে। গণমাধ্যম না থাকলে রাষ্ট্র তিন পায়া হয়ে যায়। সরকারের জবাবদিহির একটা জায়গা থাকতে হবে। মিডিয়া সে রুল প্লে করবে। তিনি একটি ধারার উল্লেখ করে বলেন, মিডিয়ার জবাবদিহিতার মাধ্যমে নাকি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটা সরকারকে বিব্রত করার জন্য করা হয়েছে। সরকারের উচিত অনুসন্ধান করা। তারা সরকারের উপদেষ্টা থাকার যোগ্য কি না দেখতে হবে।  গোলাম রহমান বলেন, গণমাধ্যমের ওপর নীতিমালা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা কেউ মেনে নেবে না। নীতিমালার গেজেট হয়েছে এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি এভাবে এগোতে চাই।  শওকত মাহমুদ বলেন, নীতিমালা ছাড়াই গণমাধ্যম উন্নতির এই পর্যায়ে পৌঁছেছে। আজকে নীতিমালার মাধ্যমে তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করা হয়েছে। নীতিমালা ছাড়াই এগোতে পারলে আজ কেন কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই নীতিমালা বাতিল করে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের দিয়ে নীতিমালার একটি প্রস্তাব করতে পারেন। তার ভিত্তিতে স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন হতে পারে। তিনি বলেন, সরকার আর রাষ্ট্রকে আজ এক করে ফেলা হচ্ছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করে আইসিটি আইনে মামলা দেয়া হচ্ছে।  মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সাংবাদিকদের চারটি বিষয়ে সুরার জন্য নীতিমালা চেয়েছিলাম। সাংবাদিকতা পেশায় নতুনদের চাকরির নিরাপত্তা, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বেতনবৈষম্য দূর করা, বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা এবং লাইসেন্স দেয়ার েেত্র একটি সুরা। কিন্তু বিদ্যমান নীতিমালায় তার উপস্থিতি নেই। আমাদের উচিত হবে নীতিমালাটি চূড়ান্তকরণের প্রক্রিয়ায় আমরা সম্পৃক্ত হই। তাহলে এ সংক্রান্ত একটি ভালো আইন হবে। তিনি বলেন, একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, দেশে উজ্জ্বল সাংবাদিকতা যেমন অগ্রসর হচ্ছে, তেমনি অপসাংবাদিকতার নজিরও আছে। দুটোকে মাথায় রেখেই আইন চাই।  শাইখ সিরাজ বলেন, আমরা একটি নীতিমালা চেয়েছিলাম। এ চাওয়ার পেছনে কয়েকটি যুক্তিও ছিল। যেমন চাইলেই যেন যে কেউ টিভির লাইসেন্স না পায়। যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন যোগ্যতার ভিত্তিতেই লাইসেন্স পায়। তিনি বলেন, বর্তমানে যে নীতিমালা করা হয়েছে এরকম নীতিমালা আমরা চাইনি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য সহায়ক নীতিমালা দরকার। এ নীতিমালায় হাত-পা বেঁধে আমাদের সাঁতার কাটতে বলা হয়েছে। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই নীতিমালা গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জের শুরু মাত্র। এর নিচে যে বরফের বিশাল পারদ সেটা আমরা দেখছি। ইতিহাস হচ্ছে ৭৩, ৭৪-এ মিডিয়াকে কণ্ঠরোধের যে চেষ্টা করা হয়েছিল ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেটা উদ্ধার করেছিলাম। মিডিয়ার কণ্ঠরোধের সেই আইনগুলোই এবারের নীতিমালায় ঢুকানো হয়েছে। এগুলো নীতিমালা নয়, ভীতিমালা। যাতে আমরা নিজেরা সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করি। এটা প্রি সেন্সরশিপের আলামত, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার তার ক্ষমতাকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য এটা করছে। অগণতান্ত্রিক পন্থায় মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশকে অগণতান্ত্রিকতার দিকে নিয়ে যাবে।  ফাহিম মোনায়েম বলেন, আমরা দেশপ্রেমিক। আমরা দেশবিরোধী কিছু করতে পারি না। তাহলে কেন আমাদেরকে বলা হবে, এটা করতে পারবে না।  ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গণমাধ্যম চাপের মধ্যে পড়লে সব মানুষের অধিকার হুমকির মধ্যে পড়ে। সম্প্রচার নীতিমালার ইতিবাচক নেতিবাচক প্রভাব শুধু গণমাধ্যম নয়, সমগ্র জাতির ওপর পড়বে। তিনি বলেন, এতে অনেক ধারা আছে, যা গণমাধ্যমকে শৃঙ্খলিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে।  সভাপতির বক্তব্যে গোলাম সারওয়ার বলেন, এই নীতিমালা এমনিতেই স্তব্দ হয়ে গেছে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, এটা গাইড লাইন। তিনি বলতে পারতেন বিটিভি যেভাবে চলে সেভাবে চালাও, তোমরা সবাই বিটিভি হয়ে যাও। তিনি বলেন, আমরা পাকিস্তানের অনেক সমালোচনা করি। কিন্তু সেখানে গণমাধ্যম অনেক শক্তিশালী। সেখানে ইমরান খানের আন্দোলন পিটিভি সরাসরি দেখিয়েছে। আমরা এই নীতিমালা প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা আজ্ঞাবহ লোকদের দিয়ে কমিশন চাই না। যোগ্য লোকদের দিয়ে কমিশন চাই।

No comments:

Post a Comment