তোবা গ্রুপের সংকট সমাধানে আন্দোলনরত শ্রমিক ও মালিকপক্ষ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। সমস্যার সমাধান হওয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি। তোবার এক হাজার ৬০০ পোশাকশ্রমিককে দুই মাসের মজুরি দেওয়ার জন্য সদস্যদের কাছ থেকে টাকা ধার করছে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এতে তোবা গ্রুপও টাকা দিচ্ছে। সংগঠনের নেতারা আশা করছেন, কাল বুধবার বিজিএমইএ কার্যালয়ে এসে মজুরি নেবেন শ্রমিকেরা। অবশ্য অনশনরত শ্রমিকেরা
বিজিএমইএর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁদের দাবি, তিন মাসের বকেয়া বেতন, ঈদ বোনাস ও এক মাসের ওভারটাইমের অর্থ একসঙ্গে দিতে হবে। এ বিষয়ে আবার বিজিএমইএ বলছে, ‘সম্ভব না’। এদিকে, বকেয়া বেতন-ভাতা ও ওভারটাইমের দাবিতে অষ্টম দিনের মতো গতকাল সোমবার তোবার শ্রমিকেরা অনশন করেছেন। নতুন করে অসুস্থ হয়েছেন আরও দুই শ্রমিক। এর মধ্যে একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অনশনের পাশাপাশি দাবি আদায়ে আজ মঙ্গলবার তোবা গ্রুপ শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি বিজিএমইএ কার্যালয় ঘেরাও করবে। এখনো তোবার মালিক দেলোয়ারের শাশুড়ি লাইলী বেগমকে নবম তলার কারখানা ভবনে আটকে রেখেছেন তাঁরা। ঈদের আগের দিন গত ২৮ জুলাই থেকে বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন তোবা গ্রুপের পাঁচ কারখানার পোশাকশ্রমিকেরা। রাজধানীর উত্তর বাড্ডার হোসেন মার্কেটের সপ্তম তলায় কারখানা ভবনে এই অনশন কর্মসূচি চলছে। গত রোববার বাণিজ্য ও নৌপরিবহনমন্ত্রী, শ্রম প্রতিমন্ত্রী এবং ১১ শ্রমিকনেতার সঙ্গে বৈঠক করে দুই মাসের মজুরি নিজেদের ব্যবস্থাপনায় দেওয়ার ঘোষণা দেয় বিজিএমইএ। টাকা নিয়ে প্রস্তুত থাকবে বিজিএমইএ: তোবার এক হাজার ৬০০ শ্রমিকের দুই মাসের মজুরি দিতে লাগবে দুই কোটি ৩৬ লাখ টাকা। আর এতে তোবা গ্রুপ ২০ লাখ টাকা দেবে। বিজিএমইএর কাছে গতকাল ১৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে তারা। এ ছাড়া, বিজিএমইএ ইতিমধ্যে ৩৫ জন পোশাক কারখানা মালিকের কাছ থেকে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। দুই মাসের জন্য ধার হিসেবে এই টাকা নিচ্ছে মালিকদের এই সংগঠন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিএমইএর এক নেতা বলেন, তোবার মালিক দেলোয়ার হোসেনের লোকজনের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে এই ধারের টাকা পরিশোধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় তোবা গ্রুপের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে মালিকদের কাছ থেকে টাকা তুললেও বিজিএমইএ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করছে না। এ বিষয়ে এস এম মান্নান বলেন, ‘আমরা টাকা জোগাড় করছি, এটাই বড় কথা। উৎস বলা যাবে না।’ সংগঠনের এই ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের জুলাই মাসের মজুরি, বোনাস ও ওভারটাইমের টাকা মালিকপক্ষ যথাসময়ে দেবে। পুরো প্রক্রিয়াটি বিজিএমইএর তত্ত্বাবধানে হবে। সে জন্য শ্রমিকদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’ তোবার শ্রমিকদের একসঙ্গে তিন মাসের বেতন-ভাতা দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা টাকা নিয়ে বুধবার প্রস্তুত থাকব। যদি কেউ না আসেন তবে আমাদের কিছু করার নাই।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ও সরকারের চাপে পড়েই বিজিএমইএ শেষ পর্যন্ত নিজেদের উদ্যোগে মজুরি দিতে সম্মত হয়েছে। তবে সদস্যদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করতে বিজিএমইএর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অনেক সদস্যই দিতে চাইছে না। তাদের শঙ্কা, এই উদাহরণ তৈরি করলে ভবিষ্যতে কোনো কারখানায় সমস্যা হলেই শ্রমিকেরা বিজিএমইএ কার্যালয়ে এসে ‘লাইন’ ধরবেন। তখন তাদেরই আবার টাকা দিতে হবে। যেটি সংগঠন হিসেবে বিজিএমইএর কাজ নয়। জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। শুধু বলেন, ‘সদস্যরা অবশ্যই বিরক্ত।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার দায়িত্ব কারখানার মালিকের। তোবার মালিকপক্ষ যদি ঠিকমতো কারখানা চালাতে না পারে ও নিয়মকানুন অমান্য করে, তবে বিজিএমইএ তাদের সঙ্গে থাকবে না। তাদের সদস্যপদ বাতিল করে দেবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গতকাল তোবার শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত টানা অনশনে ১০১ জন শ্রমিক অসুস্থ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও ১০ জন ছাড়া পেয়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালে আছেন ছয় শ্রমিক। বাকিদের অনশনস্থলের পাশেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। আর এই সহায়তা দিচ্ছে প্রগতিশীল চিকিৎসক ফোরাম। দুপুরে এই প্রতিবেদকের সামনেই রেহেনা পারভীন নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন দেলোয়ারের শ্যালক রুবেল হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখন আমরা দুই মাসের বেতন দিয়া কী করুম? টাকা দিতে হইলে আপনারে এই কারখানায় আসা লাগব। বেতন নিতে আমরা বিজিএমইএ যাইতে পারুম না।’ রেহেনার কথার সমর্থন জানান সেখানে উপস্থিত বেশ কয়েকজন শ্রমিক। মোর্চার কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা: তোবার শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের দাবিতে গতকাল শ্রম মন্ত্রণালয়ের সামনে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি পণ্ড করে দিয়েছে পুলিশ। সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবের পাশ দিয়ে সচিবালয়ের সামনে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগোতে চাইলে তাঁদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। এতে কয়েকজন আহত হন। পরে তাঁরা সেখানেই সমাবেশ করেন। বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (বাসদ) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) যৌথভাবে মিছিল-সমাবেশ করে। এতে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া, একই দাবিতে যুগ্ম শ্রম পরিচালকের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন। ৩০টি সংগঠনের প্রতীকী অনশন: অনশনরত তোবার শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে গতকাল প্রেসক্লাবের সামনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৩০টি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রতীকী অনশন করেন। সকাল ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলে। অনশনে গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগ, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি ফেডারেশন, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফোরাম, জাতীয় শ্রমিক জোট, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশনসহ ৩০ সংগঠন অংশ নেয়। এদিকে তোবার শ্রমিকদের পাওনা অবিলম্বে পরিশোধের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ও নাগরিক ঐক্য। এ ছাড়া, একই দাবিতে সংক্ষুব্ধ নারী সমাজের ব্যানারে মানববন্ধন করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, অ্যাকশনএইড, নারী মৈত্রী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম এক বিবৃতি পাঠিয়ে তোবার শ্রমিকদের পাওনা আদায়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় নিন্দা জানায়।
No comments:
Post a Comment