সরকারের বিভিন্ন পদে কর্মকর্তাদের তিন বছরের বেশি না রাখার সিদ্ধান্ত থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে আমলারা আছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে বিভিন্ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকরা (ডিজি) বছরের পর বছর একই পদ আঁকড়ে রেখেছেন। এ জন্য তাঁরা নিজেরা যেমন লবিং-তদবির করছেন, তেমনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীরাও তাঁদের সেখানেই দেখতে চান। কারণ এসব অধিদপ্তর থেকেই নিশ্চিত করা হয় মন্ত্রীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। আবার প্রধানমন্ত্রী
র কার্যালয়ের ক্ষমতাশালী কর্মকর্তারাও বিভিন্ন অধিদপ্তরে ডিজি হিসেবে আস্থাভাজনদের রাখতে চান। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিন বছরের বেশি কোনো কর্মকর্তাকে একই পদে রাখতে চায় না সরকার। এর পরও কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা একই পদে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন। বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও কাজ করছে। শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশের যে প্রশাসনিক কাঠামো তাতে নীতিনির্ধারণী কাজ করে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করে। এই হিসাবে অধিদপ্তরগুলোই সরকারের মূল কাজ করে। মূলত মন্ত্রণালয়ের হাতে তেমন কোনো বাজেট থাকে না। বাজেট থাকে অধিদপ্তরের কাছে। এ কারণে মন্ত্রী বা সচিবের ‘খরচ’ মেটায় অধিদপ্তর। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একাধিক অধিদপ্তর আছে। মন্ত্রী-সচিবরা এসব অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিজের চাহিদা পূরণ করে নেন। আইন অনুযায়ী কোনো মন্ত্রী ঢাকার ভেতরে পাজেরো জিপের মতো বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। তাঁদের ব্যবহার করার কথা ১৩০০ সিসির সিডান কার। কিন্তু প্রায় সব মন্ত্রীই ঢাকায় বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। মন্ত্রীদের এসব গাড়ি জোগান দেয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশসহ আটটি অধিদপ্তর রয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব তো বটেই অনেক কর্মকর্তা পুলিশের গাড়িও ব্যবহার করেন। অধিদপ্তর শুধু বিলাসবহুল গাড়িই দেয় না, জোগান দেয় চালক, জ্বালানি তেল, রক্ষণাবেক্ষণের খরচও। মন্ত্রী-সচিবসহ প্রভাবশালীদের গাড়ি জোগানোর জন্য বিখ্যাত স্থানীয় সরকার বিভাগ। তারা শুধু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীই নয়, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদেরও গাড়ি জোগায়। সরকারের প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির গাড়ি দরকার হলেই হাত বাড়ানো হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের দিকে। শুধু গাড়ি নয়, প্রকল্পসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে এসব অধিদপ্তরকে অনেক লোক নিয়োগ করতে হয়। এই নিয়োগের সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খান দপ্তরপ্রধানরা। মন্ত্রী-সচিবের চাহিদা পূরণের পর অধিদপ্তরের প্রধানের পালা। তিনি তাঁর ইচ্ছামতো লোক নিয়োগ করেন। এসব নিয়োগ থেকে দপ্তরপ্রধানরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিজি পদে বসে ক্ষমতার চর্চা করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিজি পদগুলো অতিরিক্ত সচিব মানের। তাঁরা সচিব হওয়ার জন্য নানা ধরনের লবিং করেন। তাঁরা সরকারের পেছনে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করেন। ফলে তাঁদেরই নানা অনিয়মে জড়ানোর সুযোগ সবচেয়ে বেশি। এ কারণে ডিজি পদে কর্মকর্তাদের তিন বছরও রাখা উচিত নয়। বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম বোর্ডের চেয়ারম্যান (ডিজি মর্যাদা) হিসেবে রয়েছেন মোস্তফা কামাল হায়দার। তিনি এ পদে যোগ দিয়েছিলেন মহাজোট সরকার শপথ নেওয়ার পরপরই ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে আছেন শ্যামল কান্তি ঘোষ ২০০৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে। সিড উইংয়ের মহাপরিচালক পদে রয়েছেন আনোয়ার ফারুক। তিনি যোগ দিয়েছেন ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে আহমদ হোসেন খান আছেন ২০১০ সালের ১৪ মার্চ থেকে। ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে আছেন আবুল হোসেইন মিয়া। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ডিজি হিসেবে রয়েছেন আবদুল মান্নান। তিনি যোগ দিয়েছেন ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর। জীবন বীমা করপোরেশনের এমডি (ডিজি পদমর্যাদার) পরীক্ষিত দত্ত চৌধুরী স্বপদে আছেন ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে। এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতে বসে আছেন নুরুন নবী তালুকদার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এ সংস্থাপ্রধানের পদ তিনি আঁকড়ে আছেন ২০১০ সালের ৪ অক্টোবর থেকে। আজমল হোসাইন ভূমি সংস্কার বোর্ডের সদস্য পদে আছেন ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে। মহাজোট সরকারের পুরো সময় পার করে তিনি এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন। ২০১১ সালের ১৯ জুলাই থেকে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান (ডিজি মর্যাদা) পদে রয়েছেন পিউস কস্তা। কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রের ডিজি পদে ২০১১ সালের ১০ নভেম্বর থেকে রয়েছেন আবদুল মতিন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব লোকাল গভর্নমেন্টের মহাপরিচালক পদে রয়েছেন কবীর আশরাফ আলম। তিনি এ পদে আছেন মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ৯ মাস আগে থেকে। জামালপুরের অধিবাসী হওয়ায় তিনি কিশোরগঞ্জ গ্রুপের সমর্থন পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। আজমল হোসাইন ভূমি সংস্কার বোর্ডের সদস্য পদে বসেছেন ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর। ভূমি সংস্কার বোর্ডের সদস্য পদে রয়েছেন জিসান আরা আরাফুন্নেসা ২০০৯ সালের ২৭ মে থেকে। প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের পরিচালক পদে সাইফুল হাসিব রয়েছেন ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যন পদে ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে আছেন শুভাশিষ বোস। জিয়াউল ইসলাম ভূমি আপিল বোর্ডের সদস্য পদে রয়েছেন ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে। সুইজারল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের ইকোনমিক মিনিস্টার পদে বিজয় ভট্টাচার্য রয়েছেন ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে।
No comments:
Post a Comment