Monday, August 4, 2014

বেআইনি হলেও কুরিয়ারে টাকা পাঠানো হচ্ছে:প্রথম অালো

কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলো বেআইনিভাবে ব্যবসা করছে। পণ্য পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি অর্থ স্থানান্তরের কাজও করছে কোম্পানিগুলো। অথচ দেশের কোনো আইন কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিকে অর্থ স্থানান্তরের এখতিয়ার দেয়নি। ফলে আপনি যদি কুরিয়ার সার্ভিসে টাকা পাঠান এবং প্রাপক তা না পায়, তাহলে আপনি কোথাও অভিযোগ করতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, মাদক, অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আনা-নেওয়ার মাধ্যম হিসেবেও কাজ করছে কুরিয়ার
সার্ভিস কোম্পানি। চাঁদাবাজ ও অপহরণকারীরা অর্থ আদায়ের জন্য কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোকে বেছে নিচ্ছে। ৩০ বছর ধরে এই কাজ চলতে থাকলেও নির্বিকার থেকেছে সব সরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েই ক্ষান্ত থাকছে। এক যুগ ধরে এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে চিঠি চালাচালিও হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা আর হচ্ছে না। দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অর্থ স্থানান্তর সম্পর্কিত আইন রয়েছে দুটি। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এবং ডাকঘর আইন, ১৮৯৮। এই দুই আইনেই কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি অর্থ স্থানান্তর করতে পারে না। ডাকঘর আইনের আওতায় সর্বশেষ মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা করা হয় ২০১৩ সালে। এতেও অর্থ স্থানান্তরের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিকে। এদিকে মানি লন্ডারিং এবং হুন্ডি ব্যবসারও অভিযোগও রয়েছে কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। অবৈধ হুন্ডি তৎপরতা, বিদেশে অর্থ পাচার এবং মানি লন্ডারিং তৎপরতা প্রতিরোধ ও দমনের কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে সরকারের একটি কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্স রয়েছে। টাস্কফোর্সের সব সভায় এমন আলোচনা উঠে এসেছে যে কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলো কাজ করছে এমনকি মাদক, অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আনা-নেওয়ার মাধ্যম হিসেবেও। ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘিত হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু বলছে না। নোটিশ দিয়ে উল্টো রিট মামলা খেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিধি প্রণয়ন করেও কার্যকর করতে পারছে না। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো) শুধু নিবন্ধন দিয়েছে কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোকে। এ নিবন্ধন ব্যবহার করে অন্য কাজ করলেও কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না রেজসকো। কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানির জন্য বর্তমানে লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ জন্য গঠন করা হয়েছে একটি কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব দিলীপ কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ১০০ কোম্পানি এ যাবৎ লাইসেন্স নিয়েছে। আরও কিছু আবেদন যাচাইয়ের কাজ চলছে।’ সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বেসরকারি পর্যায়ে চিঠিপত্র ও পণ্য আনা-নেওয়া শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। এ রকম আরও কিছু কোম্পানি নিয়ে ১৯৯৪ সালে গঠিত হয় কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএসএবি)। ওই সময় সিএসএবিকে বাণিজ্য সংগঠন (টিও) লাইসেন্স দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। তারও নয় বছর পর ২০০৩ সালের নভেম্বরে শুধু চিঠিপত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করতে পারার শর্তে সিএসএবিকে টিও লাইসেন্স দেওয়া হয়। বেআইনি অর্থ লেনদেন: টিও লাইসেন্স দেওয়ার ১৮ দিনের মাথায় ২০০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিএসএবির কর্মকাণ্ড নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, এতে কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোর অর্থ স্থানান্তরের আইনি ভিত্তি নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান বৈঠকেই জানিয়ে দেন, এ স্থানান্তর বেআইনি। একটি ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক লেনদেনের জন্য আইনগতভাবে এখতিয়ারভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেলে রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের অর্থের নিরাপত্তা বিধানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসগুলো দেউলিয়া হয়ে গেলে এ দায় নেওয়ার কেউ নেই। ডাক বিভাগের মাধ্যমে পাঠানো মানি অর্ডার হারিয়ে গেলেও সরকারিভাবে তা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এ প্রতিকার পাওয়া যায় না। ২০০৪ সালের ৮ জানুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়, সিএসএবিকে লাইসেন্স দেওয়া হলেও তারা বেআইনিভাবে অর্থ লেনদেনের কাজ করছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকও এক চিঠি দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়, টিও লাইসেন্স যেহেতু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দিয়েছে, কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোকে অবৈধ কাজ থেকে বিরত রাখার দায়িত্বও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরই। এ ব্যাপারে অবশ্য দায় এড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নিয়ে কোনো তদন্ত করছে না। কেন করছে না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিবন্ধন নেওয়া কোম্পানি নয়। সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলোর কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে দেখে না।’ জবাবাবিহীন ১০ বছর: বেআইনিভাবে অর্থ লেনদেন করছে এই তথ্য জানিয়ে সিএসএবির টিও লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না মর্মে ২০০৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংগঠনটিকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১০ বছরেও এর জবাব পায়নি। এ নোটিশের বিরুদ্ধে সিএসএবির সদস্য সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি হাইকোর্টে রিট মামলা (২৪৫৭/০৪) দায়ের করে। স্থগিতাদেশ দেন আদালত। এত বছরেও মামলাটির শুনানিই হয়নি বলে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। আর দীর্ঘসূত্রতার এই সুযোগ নিচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলো। মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিন বছরে (২০০৯-১২) ছয় দফা চিঠি পাঠায় অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে। তারাও কোনো জবাব দেয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাজার হাজার চিঠি আসে, সবগুলোর জবাব দেওয়া মুশকিল। উচিত ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ লেগে থেকে কাজটি করিয়ে নেওয়া।’ প্রথম আলোর পক্ষ থেকে খোঁজ নেওয়ার কারণে বিষয়টি তিনি আদালতে উপস্থাপন করবেন বলে জানান। নোটিশের বিপরীতে রিট মামলাটি করেছিল যে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি, তার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটির কথা তিনি ভুলেই গেছেন। তবে এর যে কোনো সুরাহা হয়নি সে ব্যাপারে নিশ্চিত তিনি। নিষিদ্ধ পণ্যের মাধ্যম: নিষিদ্ধ পণ্য চলাচলের মাধ্যম হিসেবেও কাজ করছে কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি। ফ্রান্সভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল) ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) কয়েক দফা ই-মেইল বার্তা পাঠিয়েছে। এ বার্তাগুলোতে কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের জুনে এক কেজি ৩০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করার কথা জানিয়েছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। একই বছরের সেপ্টেম্বরে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ধানমন্ডি শাখার সামনে থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে হারুনুর রশীদ নামের একজনকে। তিনি ১৩ হাজার ইয়াবা নিয়ে আসেন টেকনাফ থেকে। আগের বছর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসেরই বেনাপোল শাখা থেকে একটি পিস্তল ও ১৫৩ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ৬ ডিসেম্বর ইন্টারপোলের সহায়তায় হংকংয়ের শুল্ক কর্মকর্তারা আটক করে দুই কেজি হেরোইন। ২০০৮ সালের ১৭ জুন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে সে দেশের পুলিশ একটি টি-শার্টের প্যাকেট থেকে ৫০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে। সন্দেহভাজন ছাড়া কারও ব্যাগ খোলা হয় না উল্লেখ করে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের এমডি হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেনাপোল থেকে পিস্তল উদ্ধারে আমরাই পুলিশকে খবর দিয়েছিলাম।’ সমিতিই রয়েছে পাঁচটি: দেশে প্রকৃতপক্ষে কতটি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি রয়েছে, তার কোনো হিসাব সরকারের কাছে নেই। এমনকি সিএসএবির কাছেও নেই। সিএসএবির সভাপতি অনুমান করে জানান, ৫০০-এর মতো কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি থাকতে পারে। দেশি কোম্পানির মধ্যে এসএ পরিবহন, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস, করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস ও কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসের নাম বেশি পরিচিত। বিদেশির মধ্যে ডিএইচএল ও ফেডএক্স। কোনো একটি খাতের জন্য সাধারণত একটি করে সমিতি থাকলেও এই খাতে রয়েছে পাঁচটি সমিতি। সিএসএবি ছাড়া বাকিগুলো হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, অন বোর্ড কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পার্শেল সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ প্রাইভেট কেরিয়ার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। বাংলাদেশ পার্শেল সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং এসএ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সালাউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানির ব্যবসা পুরোপুরি বেআইনি বলা যাবে না। কারণ, এসএ পরিবহন নিবন্ধন নিয়েছে রেজসকো থেকে। কোম্পানির সংঘবিধিতে অর্থ লেনদেন করা যাবে বলে বলা রয়েছে।’ রেজসকো নিবন্ধক বিজনকুমার বৈশ্য তাঁর যুক্তিকে খণ্ডন করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ লেনদেনের অনুমোদন রেজসকো দিতে পারে না, দেয়ওনি। এটি নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট অন্য কর্তৃপক্ষ থেকে।’

No comments:

Post a Comment