নিখোঁজ স্বজনের লাশ মিলবে—এমন আশায় পদ্মাপাড়ে দিবারাত্রি হেন্য হয়ে ঘুরে ফেরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। স্বজনহারা এসব মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তাঁরা। দুঃসময়ে শোকার্ত মানুষ পেয়েছেন অদেখা–অজানা নতুন স্বজন। হারিয়ে যাওয়া কাছের স্বজনের খোঁজ পেতে এসব মানুষের বড় ভরসা হয়ে উঠেছেন দূরের এই স্বজনেরা। মাওয়া ঘাটে স্বজনের লাশের সন্ধানে আসা লোকজনের প্রতি মানবিক সহায়তা অব্য
াহত রেখেছেন এলাকাবাসী। তাঁরা শোকার্ত মানুষজনের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছেন। দুর্ঘটনার দিন থেকেই তিন বেলা খিচুড়ি রান্না করে বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাঁবুও টানানো হয়েছে তাঁদের জন্য। গতকাল বুধবার দুপুরে খিচুড়ি বিতরণের সময় মাওয়া চৌরাস্তাসংলগ্ন মেদিনীমণ্ডল এলাকার বাসিন্দা ও বাবুর্চি লিটন জানান, এলাকাবাসীর সহযোগিতায় প্রতিদিন খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। এ উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী আশরাফ হোসেন জানান, এ ছাড়া নদীর তীরে অপেক্ষমাণ স্বজনদের জন্য তাঁবু টানানো হয়েছে। এদিকে রোদ-বৃষ্টির মধ্যে নদীর তীরে অপেক্ষমাণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। একমাত্র ছেলে আমির হোসেনের লাশের খোঁজে তিন দিন ধরে মাওয়ায় পদ্মা নদীর পাড়ে অপেক্ষায় রয়েছেন মা আমেনা বেগম (৪৫)। পদ্মার তীরে মাওয়া ঘাটেই রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। স্বজনের লাশের জন্য মাওয়া ঘাটে অপেক্ষা করছেন আরও অনেকে। আমেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে ঘাটেই থাকি। খাওয়া-দাওয়াও এখানে। বৃষ্টি আইলে ভিজতে হয়। ভিজা কাপড় আবার গায়েই শুকায়। গত রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হলো। এখানে যারা আছি, সবাই বৃষ্টিতে ভিজে সারারাত কাটাইছি। ১১ বছর আগে স্বামী হারাইয়া ঢাকায় মাইনষের বাড়িতে কাম কইরা ছেলেরে বড় করছি। ছেলে পোস্তাগোলায় গার্মেন্সে (পোশাক কারখানায়) কাজ করত। পোলার লাশটাও পাইলাম না। এহন আমার কেউ থাকল না।’ ছেলের লাশের খোঁজে আমেনা একবার মাওয়ায় আবার কাওড়াকান্দি ঘাটে ছুটছেন। কারণ, লাশ ভেসে উঠলে প্রশাসন মাদারীপুরের শিবচরের কাওড়াকান্দি পাঁচ্চর স্থানে রাখার ব্যবস্থা করেছে। আর মাওয়া ঘাটে খোলা হয়েছে পুলিশ ও প্রশাসনের আলাদা নিয়ন্ত্রণকক্ষ (কন্ট্রোল রুম)। সেখানে নিখোঁজ স্বজনদের তালিকা তৈরিসহ প্রয়োজনীয় তথ্য গ্রহণ ও প্রদান করা হয়। মাওয়া ও কাওড়াকান্দি প্রায় আট কিলোমিটার দূরত্বের নৌপথ। ফলে নদীর দুই তীরে ছোটাছুটি করতে গিয়ে লঞ্চডুবিতে স্বজনহারাদের প্রচণ্ড দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের সুলতান দীঘিরপাড় এলাকা থেকে সোহাগ খন্দকার এসেছেন ভাতিজার স্ত্রী ও মেয়েকে খুঁজতে। তিনিও তিন দিন ধরে মাওয়ায় আছেন। একই এলাকা থেকে স্বজনের খোঁজে আসা মাদ্রাসাশিক্ষক আবুল হোসেন জানান, ‘থাকা ও খাওয়ার কষ্ট তো আছেই। এর মধ্যে আবার লাশের সন্ধানে আমাদের একবার মাওয়ায় আবার কাওড়াকান্দি পাড়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে।’ এসব বিষয়ে মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান জানান, কাওড়াকান্দি প্রান্তে লাশ রাখার বিষয়ে স্বজনদের মাঝে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা লাশের জন্য ওই পাড়ে থাকেন। স্বজনদের খাওয়া-দাওয়া ও থাকার জন্য মাওয়া ঘাটে নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে তিনি জানান। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলার কাশিপুর এলাকার আলী জব্বার জানান, তিনি তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে তিন দিন ধরে খুঁজছেন। তাঁর পরিবারে আরও ১৫-২০ জন স্বজন এখানে সারা দিন লাশের সন্ধানে অপেক্ষা করছেন। রাত হলে লৌহজংয়ে শিমুলিয়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকেন। কয়েক দিন ধরেই এই বৃষ্টি এই রোদ। বৈরী আবহাওয়ার কারণে মাওয়া ঘাটে লাশের সন্ধানে আসা স্বজনদের দুর্ভোগ বেড়েছে। স্বজনের লাশের খোঁজে আসা ফজল বেপারি জানান, তাঁরা চিড়া-মুড়ি খেয়ে কোনোরকমে সময় কাটাচ্ছেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘লঞ্চটি এখন পর্যন্ত শনাক্তই করতে পারল না তারা। আর কত দিন যে আমাদের এভাবে এখানে অপেক্ষা করতে হবে।’ গতকাল বুধবার দুপুর থেকে মাওয়ায় রেস্টহাউস ‘পদ্মায়’ নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সারা দিন ছিলেন। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চ শনাক্তকারী জাহাজ কান্ডারির জন্য অপেক্ষা করছি। কান্ডারি পানির তলার বস্তুকে শনাক্ত করতে পারে।’ গত সোমবার বেলা ১১টার দিকে মাওয়া ঘাটের কাছে এমএল পিনাক-৬ লঞ্চ তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। প্রায় অর্ধশত যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। গতকাল বুধবার পর্যন্ত নয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রশাসনের তালিকা অনুসারে আরও ১২৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
No comments:
Post a Comment